গত কয়েক দিনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বিষয়টি নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে, সেটি হলো আত্মহত্যা। কারণ, কয়েক দিন আগে রুয়েটের একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তারই এক দিন পর বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার বিষয় বেশ ভয়াবহতা ও উদ্বিগ্নতার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে এর মধ্যেই আবার রুয়েটের ১৭ সিরিজের সিএসই বিভাগের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা নতুবা শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়মিত না হতে পারার কারণে এবং অন্যান্য নানা কারণে বিষণ্নতায় থাকা।
পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত। কিন্তু কেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে অসীম সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েও একজন শিক্ষার্থী হতাশ হয়ে যাচ্ছেন?
সরকারি চাকরির ভেতরেই কি লুকিয়ে আছে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ? দেশের তরুণ সমাজ আর তাঁদের অভিভাবকদের মধ্যে সরকারি চাকরি নিয়ে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি অভূতপূর্ব। দিন দিন সরকারি চাকরির প্রতি শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের আগ্রহ যেন ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। এই ব্যাধি সৃষ্টির পেছনে শুধু শিক্ষার্থীদের দোষ দেখলে হবে না।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এর জন্য যথেষ্ট দায়ী। সাংবাদিকতায় পড়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সাংবাদিক হতে চান না, নাটকে পড়ে অনেকে থিয়েটার কর্মী হতে চান না, কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ে যোগ দেন পুলিশে। চিকিৎসকেরা পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার চিন্তা করেন, যাঁর হওয়ার কথা পদার্থবিজ্ঞানী, তিনি ট্যাক্স অফিসার!
সারা দেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এ সমীক্ষার তথ্য বলছে, আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪০ জন বা ৬৪ শতাংশই স্কুল পর্যায়ের।
এ ছাড়া কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। সমমান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। দেশের আট বিভাগে আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, যা মোট আত্মহত্যার প্রায় ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তার চেয়েও গভীর। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত বিধায় তাঁদের জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তাঁরা সেটা সামলাতে পারেন না। প্রেমে বিচ্ছেদ হলে তাঁরা যেমন ভেঙে পড়েন, তেমনি পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলও তাঁদের আশাহত করে।
শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার অভাব বা রাষ্ট্র কর্তৃক কর্ম প্রদানের নিশ্চয়তার অভাবের কারণেও অনেকের মধ্যে হতাশাবোধ জন্ম নেয়, যা পরে আত্মহত্যার দিকে চালিত করে। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রবণতার কারণগুলো বিভিন্নভাবে উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিষণ্নতা এবং মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেন, সামাজিক কারণগুলো হতাশা এবং মানসিক অসুস্থতার জন্য দায়ী। সুতরাং সামাজিক কারণগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা সংঘটনের জন্য দায়ী। বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় জ্ঞানার্জনের জন্য, গবেষণার জন্য, সেখানে আমাদের দেশে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় একটা ভালো চাকরির জন্য। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম।
তবে যদি একটি গবেষণানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যায়, তরুণদের মধ্যে যদি ভালো প্রতিষ্ঠানের কর্মী হওয়ার পরিবর্তে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ তৈরি করতে পারা যায়, তবে হয়তো কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীদের হতাশা দূর করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মানোন্নয়ন করতে হবে, এতে কোনো শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শিক্ষকেরা সহজেই বুঝতে পারবেন এবং হতাশা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে।
কোনো শিক্ষক যেন কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গের কারণ না হন, শিক্ষকেরা যেন হন শিক্ষার্থীদের সব থেকে বড় আশ্রয়, স্বপ্ন গড়ার কারিগর। সর্বোপরি আমাদের একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জীবনের জন্য স্বপ্ন, স্বপ্নের জন্য জীবন নয়।
সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটনার ব্যাপারে কিছুটা আশা জাগছে। এর মধ্যে একটি হলো মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন।
এ ছাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক ফার্স্ট এইড (পার্ট-১)’ নামের একটি অনলাইন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ২০২২-এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। প্রতি জেলায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একজন করে মনোবিদ নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন। ২০২৩ সালে ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইটিতে মনের যত্ন নেওয়ার একটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা তরুণ প্রজন্মকে মানসিকভাবে তৈরি হতে সহায়তা করতে পারে।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রচারণা, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং আত্মকর্মসংস্থান তৈরি, কমিউনিটি ও পরিবারের সহায়তায় হতাশামুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে এখনই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দৃঢ়করণে একজন করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সবার সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা কমানো সম্ভব।
আত্মহত্যা রোধ করা প্রায়ই সম্ভব এবং এর প্রতিরোধে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। কারও জীবনের কঠিনতম সময়ে আমাদের কর্মের মাধ্যমে, সমাজের সদস্য হিসেবে, বাবা-মা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী বা প্রতিবেশী হিসেবে অবদান রাখতে পারি। যাঁরা আত্মঘাতী হওয়ার মতো সংকটে ভুগছেন বা যাঁরা কারও আত্মহত্যায় শোকাহত, তাঁদের সহায়তায় আমরা ভূমিকা রাখতে পারি। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারি। সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ জীবনের জন্য যা অপরিহার্য। অন্যথায় এ মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন। যে সংগঠনটি ২০১৯ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করছে। তারা আত্মহত্যা কমাতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে, সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো। হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি সন্তানদের মানসিক বিকাশ এবং তাদের সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করা।
অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন করা।
প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভুক্ত করা। স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। এতে আর্থিক সংকটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে।
অন্যদিকে প্রেম-প্রণয় ঘটিত সম্পর্কে বা অজ্ঞাতসারে ধারণ করা গোপন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ ও সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে শাস্তি উল্লেখপূর্বক বিশেষ প্রচারাভিযান পরিচালনা করা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার খোলা।
শিক্ষার্থীদের বৃত্তির আওতায় এনে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ট্রেনিং দেওয়া। কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। সবশেষে শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানো বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
মোদ্দাকথা হলো, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক সংকেত। গভীর ঝড়ের পূর্বাভাস। আমরা শিক্ষিত যুবগোষ্ঠীর জন্য কী পরিকল্পনা করেছি? আমাদের পরিকল্পনা তাঁদের হতাশার দায়মোচনে সমর্থ হবে কি? বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমরা অনেকাংশেই উদাসীন। বড় ধরনের ক্ষতি কমাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেল গঠন করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
সমন্বিতভাবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বেশ জরুরি, যেন একজন শিক্ষার্থী তাঁর ব্যক্তিগত ডিপ্রেশন কিংবা সমস্যার ব্যাপারে শেয়ার করতে পারেন।
পাশাপাশি প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিয়ে, শিক্ষার্থীদের চলার পথে সব বাধা অতিক্রম করে কীভাবে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে, সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: মো. শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়