কেমন উপাচার্য চায় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সরকার তৎপর। কারণ, একসঙ্গে প্রায় ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদ খালি। সরকার পতনের সঙ্গে তাঁদেরও পদত্যাগ করতে হয়। সরকারের চেষ্টা নিরপেক্ষ, যোগ্য, সৎ, নৈতিকতাসম্পন্ন, একাডেমিক এবং গবেষণায় দক্ষ কোনো অধ্যাপককে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া, যার উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ, এ নিয়োগ অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ ইতিবাচকভাবে দেখছেন। আশা করি, এ রকম অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সরকার উপাচার্য নিয়োগ দিলে দেশ বা জাতির মঙ্গল হবে। উপাচার্যরা যদি দুর্নীতি বা আর্থিক কোনো অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন, তদন্ত করে তাঁদের দ্রুত অপসারণ করতে হবে। এই নীতি চালু হলে উপাচার্যরা দুর্নীতি করার সাহস পাবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে আরেকটি কারণ হলো, কিছু অছাত্র শিক্ষকদের সঙ্গে বাজে আচরণ করে। ছাত্র নামধারী অছাত্রদের বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর থাকতে হবে। এ জন্য লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র–শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ‘বরেণ্য শিক্ষাবিদদের’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব দিতে হবে। বরেণ্য শিক্ষাবিদেরাই স্বার্থান্বেষীদের অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক দাবি মানতে চান না। তারপরও উপাচার্য নিয়োগে একাডেমিক এক্সিলেন্সি, গবেষণায় দক্ষতা, যেমন আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে কয়টি প্রকাশনা আছে, সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা, একই সঙ্গে তাঁদের যে প্রতিষ্ঠান, সেখানে শীর্ষ পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন কি না, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। কারণ, উপাচার্য শুধু একাডেমিক বিষয়টি দেখেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক বিষয়ে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশনা দিতে হয়। তাই একজন উপাচার্যের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টিও জরুরি। যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা শক্তিশালী নয়, তাঁদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। উপাচার্য কেমন হওয়া উচিত, এ প্রসঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মতামত তুলে ধরলাম—

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে সবার জন্য কাজ করবেন—এমন কেউ একজন উপাচার্য হোন। যিনি হবেন সৎ, শিক্ষার্থীবান্ধব ও প্রশাসন চালাতে দক্ষ। রাজনৈতিক কোনো মতাদর্শের চাটুকারিতা থেকে মুক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মতামতকে প্রাধান্য দেবেন এবং তেলবাজ শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারী, ছাত্র পাশে রাখবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেষ্ট থাকবেন এবং যেকোনো অন্যায়ের সঠিক তদন্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবেন। সর্বোপরি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করার দৃঢ় মানসিকতা থাকবে—এমন একজনকে আমরা উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই।

দেলোয়ার হোসেন, শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক

উপাচার্যের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ যেমন থাকা জরুরি, সেই সঙ্গে কাজে সততা, স্বচ্ছতা, দূরদর্শিতা, নিরপেক্ষতা থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে না, তাই একজন উপাচার্যের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। তবে দায়িত্বের জায়গায় বৈষম্য করা, স্বৈরাচারী আচরণ করা এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তির কাছে কাম্য নয়। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশকে ব্যাপক আকারে প্রতিনিধিত্ব বা প্রভাবিত করে, সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও একজন উপাচার্যের দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ থাকা আবশ্যক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন, ছাত্রছাত্রীদের আবাসন, পড়াশোনা, গবেষণা এসব বিষয় যাঁর কাছে প্রাধান্য থাকবে, সেই ব্যক্তিকে উপাচার্য হিসেবে ছাত্রছাত্রীরা চায়। তা ছাড়া কর্মচারী, শিক্ষকসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের জ্ঞান, দক্ষতা ও সততার জন্য বেশ গ্রহণযোগ্যতা আছে—এমন মানুষ উপাচার্য হওয়া উচিত বলে মনে করছি।

বাঁধন চৌধুরী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, চারুকলা

উপাচার্য হিসেবে এমন একজন শিক্ষককে চাই, যিনি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করে শিক্ষার্থীবান্ধব দক্ষ একজন প্রশাসক হয়ে উঠবেন। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করার পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। কেননা, কোনো দেশ কতটা উন্নত, তার মানদণ্ড হিসেবে ওই দেশের শিক্ষা ও গবেষণাকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যপ্রবণ না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, নিয়োগ, টেন্ডারপ্রক্রিয়া প্রভৃতি স্বচ্ছতার সঙ্গে করে বাজেটের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করবেন। তৈলমর্দনকারীদের প্রশ্রয় না দিয়ে অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো অনিয়ম থেকে দূরে থাকবেন এবং কেউ চেষ্টা করলে তাকে দৃঢ়ভাবে রুখে দেবেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পক্ষপাতহীনভাবে পরিচালনায় শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি সহজ সম্পর্ক স্থাপন করবেন। শিক্ষার মনোরম পরিবেশ নিশ্চিত করে সেশনজটমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষককেই উপাচার্য হিসেবে নজরুলের আঙিনায় দেখতে চাই।

নবাব মো. শওকত জাহান কিবরিয়া, প্রাক্তন শিক্ষার্থী

দলীয় রাজনীতিমুক্ত, শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য চাই। আমরা গত ১৫ বছর পেছনে তাকিয়ে পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাব, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির বিষয়টি উঠে এসেছে। রাজনৈতিকভাবে প্রাপ্ত নিয়োগের পর দেখা যায়, এর ভেতরে আবদ্ধ থেকে চিন্তা করতে হয়। শিক্ষার্থীবান্ধব চিন্তা কমই আসে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। দলীয়করণের ফলে উপাচার্যের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির সৃষ্টি হয়। যার ফলে শিক্ষার্থীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। দিনশেষে এটাই চাওয়া থাকবে, দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য চাই। যিনি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে সর্বদা কাজ করবেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সঙ্গে গবেষণাকে সমানভাবে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে তুলে ধরতে সাহায্য করবেন।

মোছা. জান্নাতী বেগম, শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ

উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আপন করে ভাববেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র–শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে চলবেন, যোগ্যতা অনুযায়ী সবার সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করবেন এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নততর করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা করবেন।

উৎপল সরকার, প্রাক্তন শিক্ষার্থী

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ক্ষেত্রে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তিনি একজন মানুষ হিসেবে মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধসম্পন্ন হবেন এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য তৈরি করে ন্যায়ের পথ অনুসরণ করবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে নিজেকে বিকশিত করে সেই ন্যায়ের পথে চলতে সহায়তা করবেন। তৃতীয়ত, একজন প্রশাসক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে সেই পথকে মসৃণ করবেন।

সুলতানা নিগার, শিক্ষক

সুলতানা নিগার, যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করছেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি মনে করেন, বৈষম্যবিরোধী উপাচার্য দরকার, যিনি অনিয়ম করে আমাদের ক্যাম্পাসে কোনো বৈষম্য তৈরি করবেন না। অতীতের সব অনিয়মের বিচার করার মতো যাঁর সাহস ও মনোবল থাকবে। লেখাপড়ার মান উন্নত করার জন্য যাঁর প্রচেষ্টা অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে।

থাইল্যান্ডে মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাকার মুস্তাফা বলেন, অরাজনৈতিক এবং ভালো ব্যাকগ্রাউন্ডের অধ্যাপক উপাচার্য নিয়োগ হলে খুব ভালো। ভালো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, চরিত্র ও ব্যক্তিত্বে উন্নত এমন মানুষ ভিসি হয়ে আসুন।

ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক মন্টি আদিত্য বলেন, টিচিং ওরিয়েন্টেড এবং রিসার্চ ওরিয়েন্টেড—বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ক্যাটাগরির লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। সার্বিকভাবে টেকনোলজি ও পরিবেশগত উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বয় করার মতো চিন্তাভাবনা থাকতে হবে। সাসটেইনেবল ইউনিভার্সিটির কনসেপ্ট ধরে একাডেমিক শিক্ষা-গবেষণালব্ধ জ্ঞান কীভাবে সমাজের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও শ্রমবাজারের উন্নয়নে ট্রান্সফার করা যায়, সেদিকে উদ্যোগ গ্রহণ করার মতো দক্ষ হতে হবে।

সর্বোপরি একজন ভালো মানুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই আমরা।