বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ জার্মানি। তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসরমাণ এ দেশ শিক্ষাসহ নানা দিক দিয়ে ইউরোপের শীর্ষে। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত আধুনিক ও যুগোপযোগী। আছে বিশ্বের অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়। জার্মানিতে পড়াশোনা নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের চার পর্বের প্রথম পর্ব পড়ুন আজ
উচ্চশিক্ষার জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পছন্দের অন্যতম গন্তব্য জার্মানি। শিক্ষা ও গবেষণা, টিউশন ফি, শিক্ষাবৃত্তির সুবিধাসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য অন্যতম পছন্দের জায়গা জার্মানি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিকে বেছে নেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে পিছিয়ে নেই।
জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে ফার্মেসি, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পলিমার সায়েন্স, ফটো ভোলাটিকস, ইলেকট্রনিকস, মেকাট্রনিকস, জিওলজি ও মাইনিং, পলিটিক্যাল সায়েন্স, অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালস, অ্যাডভান্সড অনকোলজি, কমিউনিকেশন টেকনোলজি, এনার্জি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ফিন্যান্স, মলিকিউলার সায়েন্স, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, কম্পিউটার সায়েন্সসহ প্রকৌশল ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, ভাষা, ধর্ম, আইন ইত্যাদি বিষয়েও পড়াশোনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
শুরুতেই জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রেডিং সিস্টেমের একটু ধারণা দিচ্ছি। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিজিপিএ ১ হচ্ছে সব থেকে ভালো গ্রেড এবং সিজিপিএ ৪ হচ্ছে সব থেকে পেছনের সারির (খারাপ) গ্রেড। সিজিপিএ ৫-কে সাধারণত ফেল বলে গণ্য করা হয়। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সাধারণ যোগ্যতা প্রয়োজন সর্বোচ্চ সিজিপিএ–২ দশমিক ৫। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থীর সিজিপিএ–২ দশমিক ৫-এর কম হলেই প্রাথমিকভাবে ভর্তির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন।
এখন আপনি কীভাবে বুঝবেন জার্মান স্কেলে আপনার গ্রেড কত? এর জন্য নিচের সূত্র ব্যবহার করে জার্মান স্কেল বের করে নিতে পারবেন যে কেউ। পদ্ধতিটির নাম মোডিফাইড বাভারিয়ান ফর্মুলা।
Modified Bavarian formula
(Nmax-Nd)/(Nmax-Nmin) *3 + 1.
এখানে, Nmax: সর্বোচ্চ নম্বর, Nmin: পাস নম্বর ও Nd: প্রাপ্ত গড় নম্বর।
ধরা যাক, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট সিস্টেমে সর্বোচ্চ গ্রেড ৪.০। পাসের জন্য ন্যূনতম গ্রেড দরকার ছিল ২.০। এদিকে স্নাতকে আপনার প্রাপ্ত সিজিপিএ ৩.৫১। তাহলে আপনার জার্মান স্কেলে গ্রেড দাঁড়াবে—(৪-৩.৫১)/(৪-২) *৩ + ১ = ১.৭৩ (১.৭)।
এখানে দেখা যাচ্ছে সিজিপিএ ১.৭, যা কিনা ২.৫-এর নিচে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আপনি ভর্তির জন্য প্রাথমিকভাবে যোগ্য বলে বিবেচিত।
এখন কথা হচ্ছে, এত দেশ রেখে কেন জার্মানিতে পড়তে আসবেন? জার্মানিকে বলা হয় ল্যান্ড অব আইডিয়াস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীতে যত জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে, সেসবের অন্যতম তীর্থস্থান হচ্ছে জার্মানি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নামীদামি বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পৃথিবী বিখ্যাত মনীষীদের অনেকেরই জন্মভূমি ও কর্মস্থল জার্মানি। এ ছাড়া বর্তমান বিশ্বে যত রকমের প্রযুক্তি আছে তার অনেকগুলোর গবেষণা ও উন্নয়ন হচ্ছে জার্মানিতে। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ জার্মানি। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে জার্মানিতে পড়াশোনার জন্য কোনো খরচ নেই বললেই চলে। ধরতে গেলে সম্পূর্ণ বিনা খরচে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করা হয়। এমনকি পরীক্ষার ফিয়ের জন্যও শিক্ষার্থীদের কোনো অর্থ দিতে হয় না। শিক্ষার্থীকে শুধুই তার বাসস্থানের ও দৈনন্দিন খরচ জোগাতে হয়, যা কি না শিক্ষার্থী চাকরি করেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। যদিও কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম সামান্য বৃদ্ধি হলেও আয়ের তুলনায় জীবন যাপনে তেমন একটা প্রভাব পরেনি। কারণ, শিক্ষার্থীবান্ধব জার্মান সরকার শিক্ষার্থীদের বাসস্থানে ভর্তুকিসহ এককালীন ২০০ ইউরো প্রদান করে শুধু জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির জন্য।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিকে ধরা হয় সবচেয়ে কম খরচে উচ্চশিক্ষার জন্য অন্যতম পছন্দের দেশ। আমাদের মতো দেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী জার্মানিতে পড়তে যান, তাঁদের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে ধাপগুলো থাকে, তার মধ্যে মাস্টার্স থেকেই শুরু করাই এ ক্ষেত্রে আদর্শ বলে অন্তত আমি মনে করি।
জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স শেষ হয় চার সেমিস্টারে (দুই বছর)। এর মধ্যে তিন সেমিস্টারে বিভিন্ন বিষয়ের থিওরি ও ব্যবহারিক পাঠদান করা হয়। বাকি এক সেমিস্টারে করতে হয় থিসিস। এ ক্ষেত্রে পছন্দের নির্দিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপক নির্বাচন করে তাঁর অধীন ছয় মাসের থিসিস করে যেকোনো একটি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করা হয়। ভবিষ্যতে চাকরি বা ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য বিষয়টিই বেছে নিতে হয়।
এখানে উল্লেখ্য, থিসিসের সময়ে অনেক অধ্যাপক তার শিক্ষার্থীকে পারিশ্রমিকও দিয়ে থাকেন। যার পরিমাণ শহর ও ফান্ড সিস্টেম ভেদে ২০০ থেকে ৯০০ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। মাস্টার্স শেষ করে আপনি ফুলটাইম চাকরি করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে জার্মান ভাষার দক্ষতা মোটামুটি চাকরি ভেদে ভালো হতে হবে। এ ছাড়া ইংরেজি মাধ্যমে ফুলপেইড বা হাফপেইডে বৈজ্ঞানিক গবেষক পদে চাকরি বা পিএইচডিও করতে পারবেন৷
বাংলাদেশে যেকোনো নিবন্ধিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের স্নাতক শেষ করেই মাস্টার্সের জন্য আবেদন করা যায়। তবে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে নিজেকে গড়তে হলে দুটি বিষয়ের ওপরে জোর দিতে হয়। প্রথমত স্নাতকে যা পড়ছেন, মুখস্ত বিদ্যা থেকে বেরিয়ে এসে বুঝে পড়ুন, ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করুন। দ্বিতীয়ত, ইংরেজি ভাষার ওপরে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করুন। কিছু মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা আছে যে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নিতে গেলে জার্মান ভাষা জানা আবশ্যক, যা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। জার্মানিতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই কম–বেশি ইংরেজি মিডিয়ামে টেকনিক্যাল ও ননটেকনিক্যাল সাবজেক্ট থাকে, সুতরাং জার্মান ভাষায় শূন্য জ্ঞান রেখেও দিব্যি সেখানে ভর্তি হওয়া সম্ভব।
জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করার আগেই প্রথম কাজ হচ্ছে নিজেকে যাচাই করা। এ ক্ষেত্রে অতি আবেগকে দমিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচার করা যে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য নিজে কতটুকু যোগ্য এবং সেখানে ভাষা ও সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে কতটুকু মানিয়ে নিতে পারব। এ বিষয়ে প্রথমেই বিচার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার কিছু বেসিক মাপকাঠি উল্লেখ করে দিচ্ছি। স্নাতকের ফলাফল যদি ক্লাস সিস্টেম হয়, এ ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণি (ফার্স্ট ক্লাস) থাকা আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৬৫ শতাংশ নম্বর হলে সুযোগ পাওয়া সহজ হয়। যদি গ্রেডিং সিস্টেমের ফলাফল হয় তাহলে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.০ (৪.০) হলে চান্স পাওয়া সহজ হয়। ব্যাচেলরের পাঠদানের মাধ্যম ইংরেজি হলে এ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জনসহ অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। তারপরও নিজে চর্চা ও আইএলটিএস বা টেল্ক স্কোর ভালো হলে এই সমস্যা কাটিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। চলবে....
আগামীকাল পড়ুন: জার্মানিতে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ে কীভাবে পড়বেন
লেখক: মাহবুব মানিক, গবেষক, প্লাস্টিক ও রাবার প্রকৌশল, মের্জেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, মের্জেবুর্গ, জার্মানি