ইউজিসির কাগুজে নির্দেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপেক্ষিত, মানছে না অনেকেই

দুই বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) নির্দেশনা দিয়ে বলেছিল, ‘গেস্টহাউস’ ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকায় কোনো অফিস বা লিয়াজোঁ অফিস অথবা অন্য কোনো নামে অফিস রাখতে পারবে না। দুই বছর পর এসে সম্প্রতি আবারও একই নির্দেশনা দিয়েছে ইউজিসি। এরপরও ঢাকায় কার্যালয় চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ইউজিসি কার্যালয় থেকে কয়েক কিলোমিটারের দূরে ধানমন্ডিতে (৮/এ) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উপাচার্যের আবাসিক ভবন ও নগর কার্যালয়’ চলছে বছরের পর বছর ধরে। গত মঙ্গলবার (২৩ মে) সরেজমিনে গিয়েও এই কার্যালয়ের উপস্থিতি দেখা গেছে। আগের উপাচার্যদের মতো বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমানও অনেক কাজ এ অফিস থেকেই করেন। অথচ ঢাকার অদূরেই গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ঢাকায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কার্যক্রমও এখন আর নেই। কারণ, রাজধানীর বড় সাতটি সরকারি কলেজও ছয় বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগপত্রেও বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উপাচার্যকে সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে হবে। এর মানে তাঁর গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার কথা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবন নেই। কিন্তু অভিযোগ আছে, বছরের পর বছর ধরে এই চিত্র চললেও গাজীপুর ক্যাম্পাসে উপাচার্যের জন্য স্থায়ী বাসভবন তৈরি করা হয় না। এমনকি কোনো উপাচার্য অস্থায়ীভাবেও গাজীপুরে থাকার ব্যবস্থা করেন না। ঢাকায় থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল খরচ হচ্ছে।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির অবস্থান। কিন্তু এখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নগর ক্যাম্পাস’ চলছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে। ২৩ মে গেলে একজন কর্মী জানালেন, এটি এখন ‘গেস্টহাউস’। কিন্তু ভেতরে গিয়ে গেস্টহাউসের কোনো সুবিধাই দেখা যায়নি। বরং অফিসের সাজসজ্জা আছে। আলাদা অফিসকক্ষও দেখা গেছে। একটি অফিসের সামনে সহ–উপাচার্যের নামফলকও আছে।

এ তো গেল ঢাকায় কার্যালয় চালানোসংক্রান্ত নির্দেশনা উপেক্ষা করার নমুনা। কিন্তু শুধু এগুলোই নয়। দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক অনিয়ম বন্ধের জন্য ইউজিসি প্রায় প্রতিবছরই বিশেষ করে বাজেট বরাদ্দের সময় নানা ধরনের নির্দেশনা দেয়। কিন্তু অনেক নির্দেশনাই মানে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এমন পরিস্থিতিতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নতুন করে ৫৫টি নির্দেশনা দিয়েছে ইউজিসি। তবে প্রশ্ন উঠেছে, এবারের নির্দেশনাও কি আগেই মতোই কাগুজে হবে কিনা তা নিয়ে।

স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ মোট আয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ টাকা ভর্তিসংক্রান্ত কাজে (টেলিটক, ব্যাংক অথবা অন্য কোনো সেবা নেওয়ার খরচসহ) ব্যয় হবে। বাকি ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিয়ে পরিচালন খাতে ব্যয় করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, নানা ছুতোয় ভর্তির ফরম ফি বাবদ টাকার বড় অংশই শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নেন।

তবে ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের দায়িত্বে থাকা সদস্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেছেন, এসব নির্দেশনার ফলে অনিয়ম কমেছে। নিয়মের ব্যত্যয় হলে এবং ধরা পড়লে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যয় বাবদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ১২ হাজার ১৮৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে ইউজিসি।

অবসরের বয়স একেক রকম

বর্তমানে সারা দেশে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৪টি। এর মধ্যে একটি নতুন। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ৩০ লাখ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাতীয়, উন্মুক্ত এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকিগুলোতে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। আর মোট শিক্ষক সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি।

ইউজিসির নির্দেশনাগুলোর একটিতে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী (অবসর) আইন ১৯৭৪–এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন, সংবিধি ও পেনশন সংবিধি দিয়ে তাদের অবসর বয়সসীমা নির্ধারিত হবে। তবে পেনশন সংবিধি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এ খাতে অর্থ স্থানান্তর অথবা ব্যয় করা যাবে না। অননুমোদিতভাবে পরিশোধিত অর্থের দায়ভার ইউজিসি বহন করবে না।

ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংবিধি করতে হলেও আচার্যের অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা আইনে চললেও আর্থিক বিধিবিধানগুলো অবশ্যই সরকারের বিধিবিধানের মতোই হতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের মতো করে এসব সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের (নবম গ্রেড থেকে ওপরের গ্রেডের) অবসরের বয়স ৬২ বছর। আবার কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তাদেরও অবসরের বয়স ৬২ বছর। আবার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) কর্মকর্তাদের অবসরের বয়স ৬০ বছর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিয়েই অবসরের বয়সসীমা ঠিক করা হয়েছে।
ইউজিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর পর্যন্ত হলে গ্রহণ করছেন। ৬২ বছর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ বন্ধ হচ্ছে না

নির্দেশনা অনুযায়ী, ইউজিসির পূর্ব অনুমোদন ছাড়া অ্যাডহক (অস্থায়ী), দৈনিক ভিত্তিক, মাস্টাররোল, নিরাপত্তাকর্মী, আনসার, আউটসোর্সিং নিয়োগ দেওয়া যাবে না। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ইউজিসির পূর্ব অনুমোদন অস্থায়ী, দৈনিক ভিত্তিক, মাস্টাররোলে নিয়োগকৃতদের ক্ষেত্রে ইউজিসি থেকে কোনো টাকা বরাদ্দ করা হবে না। এবারের এই নির্দেশনা আগেও দিয়েছিল ইউজিসি।

অথচ গত মঙ্গলবার (২৩ মে) প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যত নিয়োগ হয়, তার কয়েক গুণ বেশি নিয়োগ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অস্থায়ী ভিত্তিতে।

শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই নয় আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছরে ‘খেয়ালখুশিমতো’ মতো নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই।

আরও যেসব নির্দেশনা মানতে হবে

‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণের নির্দেশিকা’ অনুসরণ করে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলেছে ইউজিসি। ন্যূনতম যোগ্যতার নির্দেশিকা না মেনে কোনো শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি হলে তাঁদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য দায়ভার ইউজিসি গ্রহণ করবে না।

নির্দেশনা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি বিলের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রচলিত নিয়মে বাড়িভাড়া কাটতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস বা ঠিকানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের আয় (ছাত্র ভর্তি ফি, টিউশন ফি, পরীক্ষাসংক্রান্ত ফি, ল্যাব টেস্টিং ফি, বিশেষ কোর্স বা সান্ধ্য কোর্স থেকে আয়, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি বাবদ আয়, বেতন থেকে কর্তনাদি, সম্পত্তি থেকে আয় ইত্যাদি) নিজস্ব আয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে বাজেটে দেখাতে বলেছে ইউজিসি। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি।

নিজস্ব আয় বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার এই পরামর্শ দুই বছর আগেও দিয়েছিল ইউজিসি। কিন্তু এটি কীভাবে হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফলে এটি অনেকটা কাগুজে নির্দেশ হিসেবেই থাকছে।

স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে বা আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ মোট আয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ বাবদ আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ টাকা ভর্তিসংক্রান্ত কাজে (টেলিটক, ব্যাংক অথবা অন্য কোনো সেবা নেওয়ার খরচসহ) ব্যয় করা যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিয়ে পরিচালন খাতে ব্যয় করতে হবে।

অভিযোগ রয়েছে, নানা ছুতোয় ভর্তির ফরম ফি বাবদ টাকার বড় অংশই শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নেন।

আগের মতো এবারও শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ‘দায়িত্ব ভাতা’ দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী মূল বেতনের ১০ শতাংশ অথবা ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে যা কম হবে, তা দিতে হবে। অতিরিক্ত হারে দায়িত্ব ভাতা দেওয়া যাবে না।

হল ও ছাত্র ইউনিয়ন এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ব্যয় ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা দিয়ে নির্বাহ করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। তারপরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এসব খাতেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকে।