দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়াতে চায় দক্ষিণ কোরিয়া। দ্য কোরিয়া হেরাল্ড ও দ্য স্ট্রেট টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, গত বুধবার দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। দ্রুত কমতে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগামী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ঠিক রাখতে এবং তিন লাখ বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পাঁচ বছরের এই পরিকল্পনা তুলে ধরেছে দেশটি।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব পরিকল্পনার মধ্যে আছে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তিবিষয়ক সরকারি নীতিতে বদল, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি বৃত্তি বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের পড়ার সময়ে কাজের সুযোগ বাড়ানো, বিদেশি শিক্ষকদের—বিশেষ করে বিজ্ঞান-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো, বিদেশি শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন চাকরির সময় বাড়ানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শেষে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থান করার সুযোগসহ নাগরিকত্বের সুযোগ রেখে ভিসা নীতিতে পরিবর্তন আনছে।
নিম্ন জন্মহার এবং প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মেধা পাচার হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনিতেই শিক্ষার্থীসংকট বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীসংকট দেখা দিয়েছে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির বিষয়গুলোতে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের দিয়েও এই সংকট কমানো যাচ্ছে না।
বর্তমানে দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যত বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন, তাঁদের ৬৮ শতাংশ চীন, ভিয়েতনাম ও উজবেকিস্তানের। গড়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির বিষয়গুলোর চেয়ে মানবিক ও বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে আগ্রহ বেশি।
সরকারি আইন অনুযায়ী, এত দিন দক্ষিণ কোরিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কোরীয় ভাষায় দক্ষতা-সম্পর্কিত পরীক্ষা দিতে হতো। টেস্ট অব প্রফিসিয়েনসি ইন কোরিয়ান (টপিক) নামের এ পরীক্ষায় ৩০ শতাংশের বেশি বিদেশি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই লেভেল-টু বা লেভেল-থ্রি শেষ করতে হবে।
এ পরীক্ষার বাধ্যবাধকতায় শিথিলতা আনছে দেশটি। বিদেশি শিক্ষার্থীরা কীভাবে এ ভাষায় ভালো দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, তা নিশ্চিতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনাও করেছে দেশটির সরকার।
সম্প্রতি এই আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তবে এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করবে। টপিক পরীক্ষাকেও বিচ্ছিন্ন একটি পরীক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষে ডিগ্রি নেবেন, তাঁদের অবশ্যই টপিক পরীক্ষায় পাস করতে হবে। এর সঙ্গে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এই পরীক্ষা অনলাইনে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিজ্ঞানে আকর্ষণ করতে বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে সরকার। প্রতিবছর এসব বিষয়ে অধ্যয়নরত ২ হাজার ৭০০ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই কাজ চলবে।
এই বৃত্তির প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নন, এমন ছয় হাজার জনকেও বৃত্তির আওতায় সহায়তা দেওয়া হবে। বৃত্তির জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন ও বৃত্তির পুরো ব্যাপারটি দেখভাল করবে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারি তহবিল গ্লোবাল কোরিয়া স্কলারশিপ প্রোগ্রাম।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অবশ্য প্রতিবছর বাড়ছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০২০ সালে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তে গেছেন দেশটিতে। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে এই সংখ্যা খানিকটা হ্রাস পেয়ে নেমে আসে ১ লাখ ৫২ হাজার ২৮১ জনে। পরের বছর ২০২২ সালে এই সংখ্যা আবার বেড়ে পৌঁছায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৯২ জনে। কিন্তু এরপরও বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যায় সন্তুষ্ট নয় কোরিয়ার সরকার। কারণ, এই খাতে দেশটির সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থী যাওয়ার হার এখনো অনেক বেশি।
এর অন্যতম কারণ হলো, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে ডিগ্রি অর্জনের পর স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। যাঁরা স্থায়ী বসবাস করতে চান না, তাঁরাও চাইলে শিক্ষা শেষে দীর্ঘ সময় দেশ দুটিতে থাকতে পারেন। এত দিন দক্ষিণ কোরিয়ার বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এসব সুবিধা ছিল না। তবে শিগগিরই ভিসা নীতি সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির শিক্ষামন্ত্রী লি জো হো।
রাজধানীর সিউলে এক সংবাদ সম্মেলনে লি জো হো বলেন, ‘আমরা ব্যাপকভাবে চাইছি, বাইরের বিভিন্ন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেশি বেশি করে দক্ষিণ কোরিয়ায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোতে পড়তে আসুক। প্রযুক্তিগত আধিপত্যের জন্য প্রতিভার (বিজ্ঞান) প্রতি লালন-পালন প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাপান ২০৩৩ সালের মধ্যে ৪ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থীকে দেশে পড়তে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
এখন কৌশলগতভাবে বিদেশি প্রতিভা আকৃষ্ট করার সময়। তাঁর মন্ত্রণালয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে ফাস্ট-ট্র্যাক ভিসা সিস্টেম চালু করছে। এতে করে আবেদনকারী বিদেশি শিক্ষার্থীরা আর লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে আটকে থাকবে না বা ভিসার জন্য সময়ক্ষেপণের মুখোমুখি হতে হবে না।
স্কিমটি কার্যকর হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্নাতকোত্তর বা ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা ছয় বছরের বদলে তিন বছরের মধ্যে স্থায়ী নাগরিক হওয়ার বা দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকত্ব পেতে পারেন।’ যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আগামী পাঁচ বছরে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যাঁরা ডি-২ ভিসা বা স্টুডেন্ট ভিসা পেয়েছেন, তাঁরা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন। আগে সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টার বেশি কাজের সুযোগ ছিল না। বিদেশি শিক্ষার্থীরা ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত খণ্ডকালীন কাজও করতে পারবেন এখন থেকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্কুল সহায়তা প্রকল্পে ৮ হাজার ৭০ কোটি কোরিয়ান ওন খরচ করা হবে। এর লক্ষ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বদল এবং সামাজিক পরিবর্তনগুলো এবং ক্যাম্পাসে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও গুণমান বাড়ানো।