দেশে একই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্রেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছেন রাব্বী-দ্যুতি দম্পতি। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বোলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা।
বোলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে স্নাতকোত্তরে বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন এস এম রাসেল রাব্বী আর শাহলা শাহনাজ দ্যুতি এ বিভাগে বৃত্তিসহ পিএইচডির জন্য মনোনীত হয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৯ সালে এসএসসি ও ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন একসঙ্গে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। ২০২১ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। এস এম রাসেল রাব্বী বর্তমানে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে (বিটাক) চাকরিতে আছেন। আর শাহলা শাহনাজ দ্যুতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের খণ্ডকালীন প্রভাষক।
শাহলা শাহনাজ দ্যুতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরু থেকেই আমাদের ইচ্ছা ছিল যেন যুক্তরাষ্ট্রে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারি। তাই প্রথমে একটু সময় নিয়ে আমরা প্রায় ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করি। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা যেহেতু গবেষণানির্ভর, তাই বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিই। পরবর্তী ধাপে আমাদের গবেষণার আগ্রহের সাথে মিলে এমন ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে আবেদনের জন্য চূড়ান্ত করি এবং এই ১০টিতে আমরা দুজনে আবেদন করি।’
এস এম রাসেল রাব্বী মাস্টার্স প্রোগ্রামে আবেদন করেছিলেন। শাহলা শাহনাজ দ্যুতি প্রতিটিতে পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমবার আবেদন করে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলেন, প্রায় সব কটি থেকেই ভর্তির প্রস্তাব পেলেও রাসেল রাব্বী একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আংশিক এবং আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পূর্ণ বৃত্তি পান। অন্যদিকে শাহলা শাহনাজ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পূর্ণ বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পান। দুজনেরই পূর্ণ বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ হওয়ায় তাঁরা একসঙ্গে বেছে নেন বোলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটি।
শাহলা শাহনাজ দ্যুতি বলেন, ‘এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ই–মেইল পাই, যেখানে লেখা ছিল পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে এবং বৃত্তির সিদ্ধান্তের জন্য স্কুল অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন থেকে একটি অনলাইন সাক্ষাৎকার হবে। যথারীতি কিছুদিন পর সংশ্লিষ্ট দুজন অধ্যাপকের সাথে আমার প্রায় আধা ঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকার চলে। সেখানে মূলত আমার গবেষণার আগ্রহের বিষয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এর কয়েক সপ্তাহ পরই আমি সেই কাঙ্ক্ষিত ই–মেইলটি পাই।’
রাসেল রাব্বী বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির শেষে ই–মেইলে জানানো হয় যে মাস্টার্সের জন্য আমি নির্বাচিত হয়েছি এবং আমি যদি যেতে আগ্রহী থাকি, তাহলে তারা আমার বৃত্তির সিদ্ধান্ত নেবে। আমি আগ্রহ প্রকাশ করে উত্তর পাঠাই এবং আমাদের দুজনকেই প্রায় একই সময়ে বৃত্তির চিঠি পাঠানো হয়।’
মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে তাঁরা জানান, পৃথিবীজুড়ে প্রযুক্তির যে ব্যাপক আধুনিকায়ন, তার একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মানুষের যোগাযোগপ্রক্রিয়ায়। প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটিক মানুষের যোগাযোগের ধারণায় অভাবনীয় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব মাধ্যমে সত্য আর মিথ্যা একাকার হয়ে উঠছে। মানুষের জীবনে প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগের যে গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব, তা-ই তাদের দুজনকে এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তুলেছে।
গত আগস্ট মাসের ফল সেশনে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করায় স্প্রিং সেশনে (জানুয়ারি ২০২৫) ভর্তি স্থানান্তর করেন তাঁরা। সম্প্রতি তাঁদের ভিসা প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষে ফ্লাইট ধরতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানে উঠবেন তাঁরা।
শাহলা শাহনাজ দ্যুতি মনে করেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে আবেদন করতে হয় প্রায় এক বছর আগে। সে অনুযায়ী গত বছর মার্চ মাস থেকে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করা শুরু করি এবং অক্টোবর মাসে আইইএলটিএস পরীক্ষা দিই। আইইএলটিএস আমাদের দুজনেই স্কোর ৭.৫। স্কোর পাওয়ার পর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে আবেদন করা শুরু করি।’
রাসেল রাব্বী বলেন, পূর্ণ বৃত্তিসহ ভর্তির জন্য স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসওপি যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে লেখা উচিত। পাশাপাশি যাঁরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাঁদের দিয়ে রিভিউ করিয়ে নেওয়া ভালো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রিকমেন্ডেশন লেটার। রাইটিং স্যাম্পল এবং সিজিপিএ—এ দুটি বিষয়ও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে ভর্তির ক্ষেত্রে।
শাহলা শাহনাজ দ্যুতি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তাঁর একটি গবেষণা প্রবন্ধ এবং রাসেল রাব্বী একটি রিভিউ আর্টিকেল রাইটিং স্যাম্পল হিসেবে জমা দিয়েছেন। তাঁরা জানান, সিজিপিএ–৩ এর ওপরে থাকা নিরাপদ। রাসেল রাব্বীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ যথাক্রমে ৩.৪২ ও ৩.২৭ এবং শাহলা শাহনাজ দ্যুতির সিজিপিএ যথাক্রমে ৩.৫২ ও ৩.৪২। এ ছাড়া দ্যুতি কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্টের দ্বিতীয় মাস্টার্সে ৬১ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন।
রাসেল রাব্বী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর যেকোনো একটি যোগ্যতা নয় বরং সব যোগত্য ও অর্জনকে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি–সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সমাজবিজ্ঞান বা কলা ও মানবিক অনুষদের বিষয়গুলোতে পূর্ণ বৃত্তি পাওয়া কিছুটা কঠিন। মাস্টার্স প্রোগ্রামে পূর্ণ বৃত্তিসহ ভর্তি আরও কিছুটা দুরূহ। রাসেল রাব্বী বলেন, ‘আমার দুরূহ কাজটি অনেকাংশে সহজ হয়েছে আমার সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য। ছাত্রাবস্থায় আমি প্রথম আলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রে বৃত্তি নিয়ে পড়তে ইচ্ছুক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তাঁরা বলেন, স্নাতকে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া ভালো। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশ করা, সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং বিভাগীয় ফলাফল ভালো রাখার চেষ্টা করা উচিত।