বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এত দিন উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো ইংরেজিভাষী দেশগুলোকে বেছে নিচ্ছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন, জাপান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির মতো ভিন্ন ভাষার দেশগুলোর প্রতিও আগ্রহী শিক্ষার্থীরা। কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব দেশে ভাষাগত সমস্যা থাকলেও বৃত্তির (স্কলারশিপ) সুযোগ বেশি। টিউশন ফির সঙ্গে থাকা–খাওয়ার খরচও অপেক্ষাকৃত কম। আর পড়াশোনা শেষে অনেক দেশে কাজেরও সুযোগ থাকে। দেশগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক—
উচ্চশিক্ষার জন্য একসময় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের দেশ ছিল জাপান। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ ধারা আরও বেড়েছে। জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, সামাজিক বিজ্ঞান, মেডিকেল, সাহিত্য, ব্যবসা প্রশাসন, পরিবেশসহ যেকোনো বিষয়ে ডিগ্রি, স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। দেশটিতে স্নাতক ডিগ্রির মেয়াদ বিষয়ভেদে চার থেকে ছয় বছর। স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মেয়াদ দুই বছর এবং পিএইচডি বিষয়ভেদে তিন থেকে চার বছর সময় লাগে। জাপানে শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের সুযোগ রয়েছে। স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ে স্কলারশিপের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি। মেক্সট স্কলারশিপ ছাড়া এডিবি-জাপান স্কলারশিপ, জাপান-বিশ্বব্যাংক বৃত্তি দেয় জাপান। এসব বৃত্তির আওতায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, ভর্তি ফি, থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের খরচ, বই কেনা, হাতখরচ, চিকিৎসা ভাতা, এমনকি জাপানে আসার বিমানভাড়াও অন্তর্ভুক্ত থাকে অনেক সময়। স্কলারশিপ পেতে দেশটির সরকারি ওয়েবসাইট ও পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে নিয়মিত নজর রাখতে পারেন আগ্রহী শিক্ষার্থীরা। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা দেশটিতে সপ্তাহে সাধারণত ২৮ ঘণ্টার মতো কাজ করার সুযোগ পান। এ ক্ষেত্রে জাপানি ভাষা জানাটা জরুরি। স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ে ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যক্রম থাকায় জাপানি ভাষা না জানলেও সমস্যা নেই। তবে স্নাতকের জন্য ভাষা শিখতেই হয়।
তুরস্কের সরকারি–বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ রয়েছে। স্কলারশিপের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও টিউশন ফি, এক বছরের তুর্কি ভাষা কোর্স ফি, থাকা–খাওয়া, স্বাস্থ্যবিমা, মাসিক ভাতা, প্রথমবার যাওয়া ও পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফেরার বিমান টিকিটের টাকা পাওয়া যায়।
উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীর অন্যতম প্রিয় গন্তব্য এখন চীন। দেশটির শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পিকিং ইউনিভার্সিটি, ফুদান ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইন চায়না, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি এবং উহান ইউনিভার্সিটি। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, মেডিকেল, সমাজবিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, কৃষিসহ অন্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডির সুযোগ রয়েছে। প্রতিবছর চীন বিদেশি শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় চায়না স্কলারশিপ কাউন্সিল ও চায়না গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ। এ ছাড়া কনফুসিয়াস স্কলারশিপ, কাউন্সিল রোড অ্যান্ড বেল্ট স্কলারশিপ, মফকম স্কলারশিপ, কাস টাওয়াস স্কলারশিপ, ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেনশিয়াল স্কলারশিপ, প্রভিন্সিয়াল স্কলারশিপ, এন্টারপ্রাইজ স্কলারশিপ, ইয়েস চায়না স্কলারশিপও আছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও কিছু স্কলারশিপ দেয়। এসব বৃত্তির আওতায় শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি, হোস্টেল ফি, স্বাস্থ্যবিমা ও মাসিক ভাতা পেয়ে থাকেন।
চীনের হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া চীনা ভাষা শেখাটা বাধ্যতামূলক নয়। সেখানকার স্নাতকোত্তর ও পরবর্তী পর্যায়ে ইংরেজি ভাষায় পড়ানো হয়। তবে জীবনযাপন সহজ করার জন্য চীনা ভাষা শেখা জরুরি। সাধারণত, প্রথম কাতারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আইইএলটিএস বা এইচএসকে (চীনা ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা) দরকার হয়। তবে কেউ যদি ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে থাকেন, তাহলে এমওআই (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) সনদ দিয়ে আবেদন করা যাবে।
উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে যুক্তরাজ্য। এরপরই জার্মানি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনির্দিষ্ট কিছু ডিগ্রি প্রোগ্রামে বিনা পয়সায় পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়। আছে শিক্ষাবৃত্তির সুবিধাও। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির সামার সেশন এবং মে থেকে জুলাইয়ের উইন্টার সেশনে আবেদন জমা দেওয়ার পরামর্শ সেখানকার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। স্কলারশিপ ছাড়া জার্মানিতে নিজ অর্থে পড়ালেখা করা ব্যয়বহুল। কাজ করার সুযোগ থাকায় অনেকে আংশিক স্কলারশিপ পেলেও জার্মানি পড়তে যান। শিক্ষার্থী হিসেবে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি মেলে। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালীন তিন মাস ছুটিতে এবং বছরে দুবার সেমিস্টার ব্রেকে ফুলটাইম কাজ করার সুযোগ আছে দেশটিতে। জার্মানরা ইংরেজিতে সাবলীল হলেও পার্টটাইম কাজ করার ক্ষেত্রে জার্মান ভাষা শিখতে হয় শিক্ষার্থীদের। দেশটিতে যেতে জার্মান ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক নয়। তবে ভাষাটি জানা থাকলে ছোট-বড় যেকোনো শহরেই কাজ পাওয়া সহজ হয়।
উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে তুরস্কের নাম। এর বড় একটি কারণ, তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ার খরচ তুলনামূলক কম। বৃত্তির সুযোগও বেশি। দেশটিতে সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ব্যবসায় প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়, সেই সঙ্গে ইসলামের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি ও রিসার্চ প্রোগ্রামের সুযোগ মেলে।
তুরস্কের সরকারি–বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষাবৃত্তি পেলে পড়ার খরচ কমে। স্কলারশিপের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও টিউশন ফি, এক বছরের তুর্কি ভাষা কোর্স ফি, থাকা–খাওয়া, স্বাস্থ্যবিমা, মাসিক ভাতা, প্রথমবার যাওয়া ও পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফেরার বিমান টিকিটের টাকা পাওয়া যায়। মাস্টার্স ও পিএইচডির শিক্ষার্থীদের পরিবারসহ থাকার সুযোগ রয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তুরস্কে বছরে সেপ্টেম্বর-ফেব্রুয়ারি সামার সেশন এবং মার্চ-জুন ফল সেশনে ভর্তি হওয়া যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দক্ষিণ কোরিয়াকে বেছে নিচ্ছেন। এর একটি কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ওপরের দিকে। কিন্তু সে অনুযায়ী টিউশন ফি খুব বেশি নয়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা থাকায় থাকা–খাওয়ার খরচ সীমিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে সাধারণত ইংরেজি ও কোরিয়ান—দুটি ভাষার দক্ষতার প্রমাণপত্র দেখাতে হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় স্নাতক ডিগ্রির মেয়াদ সাধারণত তিন থেকে চার বছর, স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মেয়াদ এক থেকে দুই বছর এবং পিএইচডি ডিগ্রির মেয়াদ তিন থেকে পাঁচ বছর হয়ে থাকে।
এদিকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তাঁদের উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, রাশিয়া, ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, সুইডেন, হাঙ্গেরি, স্পেন, চেক রিপাবলিক ইত্যাদি দেশকে বেছে নিচ্ছেন।