স্বপ্নের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে যেভাবে এলাম

ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার
ছবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

পাঁচ বছর ধরে শিক্ষকতার পাশাপাশি ‘অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার প্রজেক্টে’ একজন ‘মাস্টার ট্রেইনার’ হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে ‘অটিজম’ বিষয়ে বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য অনুপ্রাণিত করতে থাকে। এর মাঝে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের আওতায় যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম থেকে আমার দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করি।

এ সময়ের গবেষণার অভিজ্ঞতা ও তাদের গবেষণার পরিবেশ আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটাতে হলে অনেক কিছুর সমন্বয় লাগে। বিশেষ করে, বিদেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করতে চাইলে ফান্ডিং একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে ফান্ডিং জোগাড় করা অনেক কষ্টসাধ্য, কারণ, এখানে নির্দিষ্ট স্কুল থেকে প্রতিবছর খুব কমসংখ্যক স্টুডেন্টশিপ দেয়।

স্বপ্ন আর বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটাতে গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝিতে গবেষণা প্রস্তাবনা প্রস্তুত করার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে মেইল করা শুরু করি। প্রথম সপ্তাহে বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিজের ফিল্ডে অধ্যাপক খুঁজে মেইল করা শুরু করি কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলে না। কেউ ছুটিতে, কারও পিএইচডি স্টুডেন্ট কোটা পূর্ণ হয়ে গেছে, কারও সঙ্গে আবার সরাসরি ফিল্ড মিলে না।

মাঝেমধ্যেই হতাশা এসে ভর করে। মনে হতে থাকে, আমার দ্বারা বুঝি প্রফেসর জোগাড় করা সম্ভব হবে না। আসলে নিজের প্রস্তাবিত ফিল্ডে প্রফেসর খুঁজে বের করতে অনেক শ্রম দেওয়া লাগে। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ঢুকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রত্যেক প্রফেসরের এরিয়া অব ইন্টারেস্ট আর তাঁর কাজ দেখে লিস্ট করে তারপর মেইল করতে হয়।

ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে লেখক

সপ্তাহখানেক পর প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে একজন প্রফেসর পাই। তিনি সুপারভাইজ করতে রাজি হন। এই একটা মেইলের সাড়া পেয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। মনে হতে থাকে আমি পারব। এরপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন প্রফেসর মেইলের সাড়া দেন। উনি আমাকে ‘রিসার্চ কোশ্চেন’ আরেকটু আপডেট করে মেইল করতে বলেন। ব্যক্তিগত ঝামেলায় জড়িয়ে তিন দিন পর নতুন করে মেইল করি। দেরিতে উত্তর দেওয়াতে উনি আর আমার মেইলের জবাব দেননি। উনি বুঝতে পারেন আমি অলস ক্যান্ডিডেট।

এই একটি প্রত্যাখান আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। কোনো প্রফেসর যদি কোনো কাজ দেন, তাহলে বুঝতে হবে উনি আসলে ক্যান্ডিডেটকে বিভিন্নভাবে যাচাই করতে চাইছেন। তাই এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে মেইল করা উচিত।

এ দুই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে আমি পৃথিবীর প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নব উদ্যমে মেইল করা শুরু করি এবং বিভিন্ন দেশের ১২ জন প্রফেসর পেয়ে যাই, যাঁরা আমাকে সুপারভাইজ করতে রাজি হয়ে যান। এর মাঝে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে আমার বর্তমান সুপারভাইজারের মেইল পাই। উনি ছুটিতে ছিলেন বলে রিপ্লাই দিতে দেরি করেছেন। উনি আমার সঙ্গে জুমে মিটিং করতে চান। এর মাঝে উনি কো–সুপারভাইজারও ঠিক করে রাখেন।

ওনাদের দুজনের সঙ্গে আমার প্রথম মিটিং। আনন্দের পাশাপাশি ভেতরে একটা ভয়ের স্রোতও বয়ে যেতে থাকে। সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে পরের দিন বিকেলবেলা দুরুদুরু বুকে ল্যাপটপের সামনে বসি। ম্যানচেস্টার থেকে দুজন প্রফেসর আমার সঙ্গে ভিডিওতে কথা বলা শুরু করলেন। আমি প্রথমেই আমার ভয়ের কথা জানাতেই ওনারা হেসে অভয় দিলেন। এরপর আধঘণ্টা তাঁদের সঙ্গে কীভাবে কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি।

ওনারা ফান্ডিংয়ের কথা বললে আমি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ ও প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের কথা বলি। এর সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের নিজস্ব ফান্ডিং অপশন আছে কি না, সেটা জিজ্ঞাসা করি। তখন ওনারা বলেন, ইন্টারনাল ফান্ডিং আছে, তবে সেটি প্রতিবছর খুবই কমসংখ্যক শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তবে তুমি আবেদন করে রাখতে পারো।

মিটিং শেষে এবার মেইল চেক করতে থাকি। এরপর রাত ১০টার দিকে সেই কাঙ্ক্ষিত মেইল। ওনারা আমাকে সুপারভাইজ করতে রাজি হয়েছেন। এরপর আবেদন করতে বললেন। গত বছর দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন বিকেলে বসে আবেদন করি। আবেদনের সময় ম্যানচেস্টারের নিজেদের ফান্ডিং অপশন অ্যাসেস করার বিষয়টি ভুলে যাই। এরপর রাতে এসে আবার মেইল করি। ওরা আমার পোর্টালে ওদের ফান্ডিং অপশন আপডেট করে দেয়। এ যেন ডেসটিনি!

আসলে একেকটা আবেদন মানে অনেক ঝামেলা। ওদের মতো করে গবেষণার প্রস্তাবনা তৈরি করা, সিভি তৈরি করা, স্টেটমেন্ট অব পারপাস লেখা, রেফারেন্স লেটার জোগাড় করা, ক্রেডিট কার্ড থেকে আবেদন ফি পরিশোধ করা, কাগজপত্র আপলোড করা। সব মিলিয়ে অনেক পরিশ্রম। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেছি। এবার ম্যানচেস্টার থেকে মেইল এল, সুপারভাইজার, কো–সুপারভাইজার ও অ্যাডমিশন কমিটির দুজন আমার সঙ্গে আবার মিটিং করতে চান। বাড়িতে নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় আমি অডিওতে ওনাদের সঙ্গে যোগ দিই। ওনারা আমার বিষয়টি বুঝতে পারেন। এরপর ওনাদের সঙ্গে টানা ৪৫ মিনিটের মিটিং।

এরপর আট মাসের অপেক্ষা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত বারবার মেইল চেক করি। প্রথম চার জায়গায় ব্যর্থ হই। মনে হতে থাকে আমার বুঝি পিএইচডি ফান্ডিং হলো না। এরপর গত ১৬ মে রাত ৯টার পর সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের অ্যাডমিশন কমিটির পক্ষ থেকে আসা মেইলের দ্বিতীয় লাইন ‘we are delighted to inform you that’ দেখে শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায়। বুঝতে পারি, সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এসে গেছে। বারবার মেইল পড়ে নিশ্চিন্ত হই যে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়ে গেছি।

টিউশন ফিস, লিভিং অ্যালাউন্স, সেমিনার অ্যালাউন্স—সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ পাউন্ডের স্কলারশিপ! এ যেন স্বপ্নের চেয়েও অনেক বড় কিছু। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার তালা থানার ঘোনা গ্রামে কাদামাটির গন্ধে বেড়ে ওঠা এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আজ পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে দাঁড়িয়ে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনছি। আমার গবেষণালব্ধ ফলাফল যেন দেশের ও মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারি, সেই স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে।

  • লেখক: সুব্রত কুমার মল্লিক, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ স্টুডেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য