দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনাম। দেশটি চলে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের দীর্ঘ বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হো চি মিন। ভিয়েতনামের জনক তিনি। মানবমুক্তির লড়াইয়ে তাঁর নেতৃত্ব হয়ে আছে চিরস্মরণীয়। ইকোনমিস্টের চোখে দেশটির স্কুলগুলোয় বর্তমানে পড়াশোনা ও এর পদ্ধতি নিয়ে বিশদ বিবরণ ছাপা হয়েছে।পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো—
উন্নয়নের পথ নিয়ে হো চি মিনের একটি কথা বেশ প্রচলিত আছে। তিনি বলতেন, ‘১০ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনা করলে বেশি বেশি গাছ রোপণ করতে হবে। কিন্তু যদি ১০০ বছরের পরিকল্পনায় যেতে হয়, তবে মানুষের মনের ও মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।’
বছরের পর বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভিয়েতনামের জনপ্রতি জিডিপি মাত্র ৩ হাজার ৭৬০ ডলার, যা তাদের আঞ্চলিক সমকক্ষ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের তুলনায় কম। তবে ভিয়েতনামীদের ভালোভাবে লালন–পালন করার জন্য এ অর্থ যথেষ্টই। এরপরও পৃথিবীর অন্যতম ভালো শিক্ষাব্যবস্থা ভিয়েতনামের।
শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে তারা অন্য দেশের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষাক্ষেত্রে ভিয়েতনাম শুধু তার পাশের দেশ মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডকেই ছাড়িয়ে যায়নি, তাদের থেকে ছয় গুণ ধনী দেশ যুক্তরাজ্য ও কানাডাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ভিয়েতনামের শিক্ষার্থীদের স্কোর (বিভিন্ন মানদণ্ডে) বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করলেও থাকে ওপরের দিকেই।
নানা কারণে শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহ বা ঝোঁক তৈরি হয়। এর অনেকটাই শুরু হয় পরিবার থেকে মা-বাবার হাত ধরেই। তবে ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এ উদাহরণ খুব একটা খাটে না। এ দেশে শিক্ষার্থীদের সাফল্যের মূল রহস্য লুকিয়ে আছে তাদের শ্রেণিকক্ষে। বিশেষ করে, ছোটবেলায় সেখানকার শিশুরা সব থেকে বেশি শেখে।
২০২০ সালে সুইডেনের স্টকহোম স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ সিং এক গবেষণায় ভিয়েতনামের এ সফলতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। গবেষণার জন্য তিনি ইথিওপিয়া, ভারত, পেরু ও ভিয়েতনামের নানা তথ্য (ডেটা) বিশ্লেষণ করেছেন। দেখিয়েছেন, পাঁচ থেকে আট বছরের শিশুদের মধ্যে ভিয়েতনামের শিশুশিক্ষার্থীরা অনেকটাই এগিয়ে। যেকোনো সাধারণ গুণজাতীয় সমস্যা সমাধানে ভারতের শিক্ষার্থীদের গড় স্কোর যেখানে ৬, সেখানে একই বয়সের ভিয়েতনামের শিশুশিক্ষার্থীদের স্কোর ২১।
ভিয়েতনামের স্কুলগুলো অন্য দরিদ্র দেশের তুলনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে। এর প্রমাণ মেলে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট’-এর ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাও। সে গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে উন্নয়নশীল ৮৭টি দেশের মধ্যে ৫৬টির দেশের শিক্ষার মানে ধারাবাহিকভাবে অবনতি হয়েছে। সেখানে একই সময় ভিয়েতনামের স্কুলগুলো ধারাবাহিকভাবে ভালো করেছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক ভালো না করার প্রবণতাকে ভেঙে দিয়েছে দেশটি।
এখন মনে হতে পারে কেন দেশটি স্কুল শিক্ষায় ভালো করছে? এর উত্তর হচ্ছে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যের অন্যতম কারণ শিক্ষকেরা। তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ ও পারদর্শী—ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয়। আসলে ক্লাসে তাঁরা অনেক সক্রিয়, শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক ও শিক্ষার্থীদের বোঝাতে সক্ষম হন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপসাগরীয় দেশগুলোর একটি মানদণ্ডে ভারত ও ভিয়েতনামের শিক্ষার্থীদের অঙ্কে পারদর্শিতার পার্থক্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। এর মূল কারণ হলো শিক্ষার মানের পার্থক্য।
ভিয়েতনামের শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন। কারণ, ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। তাঁদের মাঝেমধ্যেই প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছে ক্লাসগুলো বিভিন্নভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার স্বাধীনতা আছে শিক্ষকদের। অঞ্চলগত বৈষম্য কমানোর জন্য শহর থেকে দূরাঞ্চলের শিক্ষকদের বেশি বেতন দেওয়া হয়। এ ছাড়া শিক্ষকদের মূল্যায়ন করা হয় তাঁর ক্লাসের শিক্ষার্থীরা কতটা ভালো করছে, তার ওপর। সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের ভূষিত করা হয় ‘টিচার এক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ডে।
আসলে এতকিছু সম্ভব কারণ ভিয়েতনামের ক্ষমতাসীন দল শিক্ষা নিয়ে খুবই আগ্রহী। কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত দেশটি প্রাথমিক শিক্ষাকে ভালো করতে নানা উদ্যোগ পুরো দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরাই। অবশ্য তাদের এ আগ্রহের আরও নানা সুবিধা রয়েছে। ভিয়েতনামের বার্ষিক বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ থাকে শিক্ষায়। আর বরাদ্দের সমবণ্টন হয় দেশের সব প্রদেশের স্কুলে। বর্তমান সরকার শিক্ষাব্যবস্থা হালনাগাদ রাখতে এবং শিক্ষার মানদণ্ড ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষানীতি প্রণয়ন আর শিক্ষকের মানোন্নয়নেও মনোযোগ তাদের। শুধু সরকারের নানা উদ্যোগই নয়, ভিয়েতনামের পরিবারগুলো শিক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর অন্তর্নিহিত কারণ কনফুসিয়ানিজম বা কনফুসিয়াসের শিক্ষা। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সামাজিক খাতের কর্মকর্তা এনগো কুয়াং ভিন বলেছেন, ‘এমনকি দরিদ্র মা–বাবারা নিজে পড়তে না জানলেও শিশুদের পড়ানোর জন্য শিক্ষক খোঁজেন। শহর–গ্রামে অনেকে নিজ সন্তানকে ভর্তির জন্য এমন স্কুল খোঁজেন, যেখানকার শিক্ষকেরা ‘শিক্ষায় শ্রেষ্ঠত্ব’-এর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
আড়াই হাজার বছর আগে কনফুসিয়াসের চিন্তা চীনের ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য ও মূল্যবোধকে সংহত রূপ দিয়েছিল। এটি রীতিমতো বিস্ময়কর ব্যাপার। চীনের কথা বাদ দিলেও জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের সংস্কৃতিতে এখনো দাগ লেগে আছে কনফুসীয় মতবাদের। এ মতবাদ ছড়িয়ে আছে ইউরোপ–আমেরিকা, এমনকি আফ্রিকাতেও।
এসবের জন্য ভিয়েতনামের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যার ফলে দেশের অর্থনীতিরও উন্নতি হয়েছে। রাজধানী হ্যানয়ভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান মেকং ডেভেলপমেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট। এ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ফুং ডক টুং জানিয়েছেন, এ উন্নয়ন প্রভাবের পরীক্ষা নিচ্ছে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ, শিক্ষার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের (চাকরি) মধ্যে একটা তফাত আছে। কর্মক্ষেত্রের নিয়োগকারীরা কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও বাস্তবধর্মী দক্ষতা, যেমন টিম ম্যানেজমেন্টের কাজ করার পারদর্শিতাসহ নানা কিছু চায়।
কিন্তু ভিয়েতনামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ দক্ষতার একটু ঘাটতি লক্ষণীয়। অনেক শিক্ষক বেসরকারি খাতে বেশি বেতনের চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। তাই শিক্ষার মান ধরে রাখতে ভিয়েতনাম সরকারকে আরও নানা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঠিক হো চি মিন মানুষকে মনে করিয়ে দিতে পছন্দ করতেন যে ‘মানুষের মনের ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ক্রমাগত মনোযোগ প্রয়োজন’, ঠিক তেমনি।