ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
উপাচার্য মুহাম্মদ আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগে অনিয়ম। আছে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। অন্যদিকে সহ-উপাচার্য মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ, মাদ্রাসার নতুন অধিভুক্তি-নবায়ন-পরিদর্শনের নামে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তদন্ত কমিটি গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
অবশ্য উপাচার্যের দাবি, অভিযোগ সত্য নয়। অভিযোগের বিষয়ে সহ-উপাচার্যের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর ইউজিসি বলছে, আসল ঘটনা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির আগের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এখন বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য উভয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, এখানে নিয়োগের বিষয়টি একটি বড় ব্যাপার। অধিভুক্ত মাদ্রাসার ‘সমস্যার’ সূত্র ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ নানাভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। একটি সাধারণ অভিযোগ দাঁড়িয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ কোনো কাজে অধিভুক্ত মাদ্রাসায় গেলেই ‘লাভবান’ হন। এসব নিয়ে পাল্টাপাল্টি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। তা ছাড়া বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আলোচনা আছে।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায়। এটি মূলত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি অ্যাফিলিয়েটিং (অধিভুক্তিবিষয়ক) বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের ফাজিল ও কামিল পর্যায়ের মাদ্রাসাগুলো এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে। আগে তা চলত কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা ১ হাজার ৩৪৯টি। অধ্যয়নরত মোট শিক্ষার্থী প্রায় পৌনে তিন লাখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রশীদ গত বছরের এপ্রিলে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। একই বছর তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের একজন ‘কর্মী’ এ অভিযোগ দেন। এতে উপাচার্যের বিষয়ে ১০টি অভিযোগ করা হয়। এসব অভিযোগের বিষয়ে গত বছরের নভেম্বরে ইউজিসিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গত জানুয়ারিতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক হাসিনা খান কমিটির আহ্বায়ক।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ইউজিসির নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা আমলে না নিয়ে টাকার বিনিময়ে একজনকে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির নাম কামরুল ইসলাম। তাঁর এক মেয়াদ শেষ হয়েছে। মেয়াদ আবার বাড়ানো হয়েছে। কামরুল পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার (উপরেজিস্ট্রার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নীতিমালা অমান্য করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অর্থ ও হিসাব শাখায় পরিচালক পদে লোক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উপাচার্যের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। এ ছাড়া অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া ১৬তম গ্রেডের একজন কর্মচারীকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তার পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কামরুলকে তিনি চিনতেনই না। কামরুল আবেদন করেছেন, লিয়েনে (অনুমতিসাপেক্ষে অন্যত্র চাকরি) নিয়োগ পেয়েছেন। এখানে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া এখানে দীর্ঘদিন ধরে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হচ্ছে। কেন করা হচ্ছে, তা তিনি জানেন না। আর বর্তমান সহ-উপাচার্যের সঙ্গে তাঁর কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
গত বছরের নভেম্বরে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য আবুল কালামের বিরুদ্ধে ইউজিসির চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে মোট ১৭টি অভিযোগ করা হয়। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে অনিয়ম, নিয়োগ-বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ, বিভিন্ন মাদ্রাসা পরিদর্শনের নামে টাকা আদায়।
অভিযোগের বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে হাসিনা খানকে আহ্বায়ক করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি।
অভিযোগে বলা হয়, ফাজিল-কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগের বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে যেতেন সহ-উপাচার্য। নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি আর্থিক অনিয়ম করেছেন।
অসংখ্য মাদ্রাসার তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে মাদ্রাসায় যান সহ-উপাচার্য। বিভিন্ন ব্যাপারে তিনি মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁর আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অভিযোগ করা হয়।
মাদ্রাসার নতুন অধিভুক্তি ও অধিভুক্তির নবায়ন বাবদ সহ-উপাচার্য টাকা আদায় করেন বলে লিখিত অভিযোগে বলা হয়। তিনি টিএ-ডিএর নামে প্রচুর টাকা নেন বলেও অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, ২০২৩ সালের জুনে তিনি দুই লাখ টাকার বেশি এমন অর্থ নিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি অনুমোদনের নামে টাকা নেওয়া।
অভিযোগের বিষয়ে সহ-উপাচার্য আবুল কালামের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে ইউজিসির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হাসিনা খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদন তৈরির কাজটি একটি পর্যায়ে চলে এসেছে। উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার আছে। সেগুলো তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবেন বলে তিনি আশা করছেন।