শিক্ষকেরা শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়; বরং শিক্ষার্থীদের জীবনের নানা দিক সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলেন। তবে এ পেশায় যেমন সম্মান রয়েছে, তেমনই রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা। বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়, যা শুধু তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে না, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানকেও প্রভাবিত করে। শিক্ষকের কর্মক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যা—
১. ক্লাসরুমের বড় আকার ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের সমস্যা
বর্তমান সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একেকটি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি হয় যে একজন শিক্ষক এককভাবে তাদের প্রয়োজনীয় যত্ন ও মনোযোগ দিতে পারেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ভারসাম্যহীনতা শিক্ষার গুণগত মানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে গিয়ে শিক্ষক অনেক সময় হতাশ ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
২. বেতন ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধার অভাব
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতনকাঠামো ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। অধিকাংশ শিক্ষকই মনে করেন, তাঁরা কাজের তুলনায় পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। এই আর্থিক অস্থিরতা অনেক শিক্ষককে অন্য পেশায় যোগ দেওয়ার দিকে ঠেলে দেয়, যা শিক্ষা ক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষকের সংকট তৈরি করে।
৩. প্রশাসনিক কাজের চাপ
শুধু পাঠদান নয়, শিক্ষকদের আরও নানা প্রশাসনিক কাজ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন, পরীক্ষার খাতা দেখার পাশাপাশি অনেক সময় প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসব কাজের বাড়তি চাপের কারণে শিক্ষকেরা তাঁদের মূল কাজ, অর্থাৎ পাঠদানের প্রতি যথাযথ সময় দিতে পারেন না।
৪. মানসিক চাপ ও বার্ন আউট
শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে মানসিক চাপ একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের আচরণগত সমস্যা, অভিভাবকদের চাহিদা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক চাপে শিক্ষকেরা প্রায়ই মানসিক চাপের শিকার হন। শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ থেকে বার্ন আউট (burnout) হতে পারে, যা তাঁদের কর্মদক্ষতা ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে।
৫. প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সমর্থনের অভাব
বর্তমান সময়ে শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। তবে অনেক শিক্ষক এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবের কারণে তাঁরা ক্লাসরুমের কার্যকর ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ ছাড়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা না থাকায় শিক্ষকদের কাজের মান ও কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য সমাধান
শিক্ষকেরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেগুলোর সমাধানের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষাদানের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং শিক্ষকেরা তাঁদের কাজের প্রতি আরও উৎসাহী হবেন। নিচে কিছু সমাধানমূলক প্রস্তাব দেওয়া হলো—
১. শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ঠিক রাখা
শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নত করতে হলে প্রথমেই ক্লাসরুমের আকার ছোট করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত যথাযথ রাখতে হবে, যাতে একজন শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানে আরও শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত রাখলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই ভালোভাবে শিখতে ও শেখাতে পারবেন।
২. বেতনকাঠামো উন্নত করা ও আর্থিক প্রণোদনা
শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও পেশাগত উন্নতির জন্য তাঁদের বেতনকাঠামো উন্নত করতে হবে। যথাযথ বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলে শিক্ষকেরা আরও উৎসাহী হয়ে কাজ করবেন। তাঁদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হলে তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে এই পেশায় টিকে থাকতে পারবেন এবং শিক্ষার মানও বজায় থাকবে।
৩. প্রশাসনিক কাজের ভার হ্রাস
শিক্ষকদের মূল কাজ হচ্ছে পাঠদান। তাই তাঁদের ওপর অতিরিক্ত প্রশাসনিক কাজের চাপ দেওয়া উচিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রশাসনিক বিভাগ থাকতে হবে, যাঁরা শিক্ষকদের প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবেন। শিক্ষকেরা যেন তাঁদের ক্লাসে যথাযথ মনোযোগ দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৪. মানসিক চাপ মোকাবিলায় সহায়তা
শিক্ষকদের মানসিক চাপ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা উচিত। নিয়মিত কাউন্সেলিং সেশন, মানসিক প্রশান্তির জন্য কর্মশালা এবং কাজের চাপ হ্রাসে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। পাশাপাশি, শিক্ষকেরা যেন নিয়মিত বিশ্রাম পান এবং তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত ছুটির ব্যবস্থা রাখা উচিত।
৫. প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ প্রদান
বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের ডিজিটাল শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তাঁরা শিক্ষার্থীদের আরও কার্যকরভাবে শেখাতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ইন্টারনেট সংযোগ ও কারিগরি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. শিক্ষক উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা প্রয়োজন। এ ধরনের কর্মসূচি তাঁদের পেশাগত দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করবে ও শিক্ষাদানের নতুন কৌশল সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করবে। শিক্ষক উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের দক্ষতা আরও শাণিত করতে পারবেন।
৭. শিক্ষকদের কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি
শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া তাঁদের পেশাগত জীবনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাঁদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদান করলে তাঁরা আরও অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করবেন। প্রতিযোগিতা বা পুরস্কারের মধ্য দিয়ে তাঁদের কাজের মান উন্নয়ন ও প্রেরণা বাড়ানো সম্ভব।
শিক্ষকতা এমন একটি পেশা, যেখানে শুধু পাঠদান নয়, শিক্ষার্থীদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বও রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে শিক্ষকেরা তাঁদের কর্মজীবনে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তবে এসব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শিক্ষকেরা তাঁদের কাজের প্রতি আরও উৎসাহী হতে পারেন এবং শিক্ষার মান উন্নত করতে পারেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি শিক্ষকদের সমস্যাগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয় এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে, তবে শিক্ষাদান পদ্ধতি আরও উন্নত হবে এবং শিক্ষার্থীরাও লাভবান হবে। শিক্ষকদের মানসিক, পেশাগত ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল একটি শিক্ষাব্যবস্থা তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে।
*লেখক: মো. মোকাদ্দেছ উর রহমান, শিক্ষক