ভারতের রাজস্থান রাজ্যের কোটার পরিচিতি দেশজুড়ে। শহরটিকে ভারতের ‘শিক্ষার কাশীধাম’ও বলা হয়। এ শহর কোচিংয়ের কারণে ব্যাপক পরিচিত। কোচিং–বাণিজ্যের আর্থিক মূল্য ১২০ বিলিয়ন রুপি।
প্রতিবছর তিন লাখের বেশি শিক্ষার্থী সেখানে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এ শহরে দিনে ১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করা সাধারণ ব্যাপার এবং সেখানে পরীক্ষার নম্বরই যেন সবকিছু। এখান থেকেই কেউ কেউ ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হয়ে উঠবেন। কিন্তু যাঁরা ব্যর্থ হবেন, তাঁদের জীবনে কী ঘটে, সেটিই এ প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য।
কোটা সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ‘কোচিং ক্যাপিটাল’ বা ‘কোচিংয়ের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সেখানে ডজনের বেশি ইনস্টিটিউট রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে অত্যন্ত কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেন।
ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের কম। বর্তমানে যে পরিমাণে তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন বা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, দেশটির ইতিহাসে তা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে কয়েক গুণ।
চলতি বছরে মাত্র ১ লাখ ৪০ হাজার আসনের বিপরীতে ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় (নিট) অংশ নিয়েছিলেন। অন্যদিকে ‘আইআইটি’ নামে পরিচিত শীর্ষ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১০ হাজার আসনে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী।
এ শহরের কোচিংয়ে অধ্যয়নরত লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনযাপন ও পড়াশোনার সময়সূচি শুনলে অনেকে অবাক হতে পারন। এখানকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর বয়স ১৭ থেকে ২০–এর মধ্যে। পাঠ্যক্রমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাঁরা সপ্তাহে ৭ দিনই প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। অনেকে বলেন, তাঁরা ছয় ঘণ্টার ক্লাসে অংশ নেওয়ার আগে ভোর চারটায় পড়া শুরু করে। প্রতি ব্যাচে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী থাকেন। তাঁদের প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে পরীক্ষা দিতে হয়। তাঁদের প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী সর্বজনীনভাবে র্যাঙ্ক করা হয়।
অনেক অভিভাবকের কাছে ব্যর্থতার জন্য কোনো জায়গা নেই, তাই নম্বরের জন্য শিক্ষার্থীরা নিজেদের অনুভূতি, আবেগ—সবকিছু বাদ দিয়ে পড়াশোনা করেন।নীনা বিজয়বর্গ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোটার কোচিংয়ে পড়ছেন ২২ বছর বয়সী রানী কুমারী। তিনি বলছেন, ‘বন্ধুদের জন্য বা সামাজিকতা করার জন্য আমার সময় নেই। এখন বইই আমার বন্ধু। ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী শ্রী কুমার ভার্মা কোটার সবচেয়ে বড় কোচিং স্কুল অ্যালেন ক্যারিয়ার ইনস্টিটিউটে নিট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কুমার ভার্মার ভাষ্য, ‘এটি পুরো ভারতের সবচেয়ে চাপের শহর। আপনি যে দিকেই তাকাবেন, দেশের তরুণদের হতাশা অবস্থা দেখতে পাবেন। তাই অনেকেরই স্বপ্ন থাকে একজন চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার এবং সেখানে পড়ার সুযোগ পেতে শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম করেন।
কোটা হয় আপনাকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যাবে অথবা আপনাকে হতাশায় নিমজ্জিত করবে। এখানে সব আছে, আবার কোনো কিছুই নেই।’
আমি সপ্তম শ্রেণিতে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই আমার নাতির শিক্ষার জন্য কোনো অনিচ্ছা ছাড়াই কৃষিজমি বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আশা করি, ডাক্তার বা প্রকৌশলী হিসেবে তারা ফিরে আসবে।রামদাস কোর্দে, মহারাষ্ট্রের ৬৯ বছর বয়সী
শিক্ষার্থীদের সাফল্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষার দেখা মেলে মন্দিরে গেলে। শহরের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের দেয়ালে হাজারো প্রার্থনাবাক্য লেখা আছে। সেখানে লেখা আছে—‘হে ঈশ্বর আমাকে সফলতা দিন’, ‘হে কৃষ্ণ, অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে থাকুন, অনুগ্রহ করে আমার মা–বাবাকে খুশি রাখুন, অনুগ্রহ করে আমাকে নিট ২০২৪–এ সফল হতে সাহায্য করুন’ এবং ‘ঈশ্বর আমাকে শেখান কীভাবে খুব কঠোর পরিশ্রম করতে হয়’।
মন্দিরের পণ্ডিত রাধে শ্যাম বলেন, প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর দেয়াল মুছে পরিষ্কার করা হয়, যেন অন্যরা সুযোগ পান।
কোটার সর্বব্যাপিতা এমন যে এটিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের ‘শিক্ষার কাশীধাম (পবিত্র শহর)’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এখানে এ খাতের আর্থিক মূল্য এখন আনুমানিক ১২০ কোটি রুপি।
কোটাকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের ‘শিক্ষার কাশী (পবিত্র শহর)’ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এখানে এ খাতের আর্থিক মূল্য এখন আনুমানিক ১২০ কোটি রুপি। প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যাঁরা সফল হন, তাঁদের সঙ্গে সেলিব্রিটি বা তারকাদের মতো আচরণ করা হয়। তাঁদের ছবি বিশাল বিলবোর্ডে টানানো হয়।
প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যাঁরা সফল হন, তাঁদের সঙ্গে সেলিব্রিটি বা তারকাদের মতো আচরণ করা হয়। তাঁদের ছবি বিশাল বিলবোর্ডে টানানো হয়। নিজ কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাঁদের জন্য এক লাখ রুপির নগদ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
কিন্তু এত কিছুর পরও কোটার একটি অন্ধকার দিকও আছে। কোটায় কোচিংয়ের সংস্কৃতি এবং শিক্ষার্থীদের একাডেমিক, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ তাঁদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এ জন্য এ বছর এখন পর্যন্ত (অক্টোবর) নগরীর কোচিং স্কুলে অধ্যয়নরত ২৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
এটি সংখ্যায় রেকর্ড। সমস্যাটির মাত্রা এত বেড়েছে যে সরকারের কিছু মন্ত্রী কোচিং স্কুলগুলোকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিষয়টি রাজ্যের বিধান সভায়ও উত্থাপিত হয়েছে। গত অক্টোবরে রাজস্থান রাজ্য সরকার আত্মহত্যার হার রোধ করার প্রয়াসে একটি নতুন নির্দেশিকা চালু করেছে। শিক্ষার্থীদের ঘর থেকে সিলিং ফ্যান সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ, শিক্ষার্থীরা যেন এটি ব্যবহার করে আত্মহত্যা করতে না পারেন।
শুধু কোচিং সেন্টারগুলোরই সমালোচনা হচ্ছে, তবে শিক্ষার্থী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি চাপ আসে পরিবারের কাছ থেকে। পরিবারে একজন চিকিৎসক বা একজন প্রকৌশলী থাকা উচ্চ মর্যাদার বলে মনে করেন ভারতীয়রা। অনেক মা–বাবা তাই কোটাকে সাফল্যের পথ হিসেবে দেখেন।
কোটায় কর্মরত একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নীনা বিজয়বর্গ বলেছেন, ‘আমি বলব, আমার দেখা বেশির ভাগ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ মা–বাবার অতিরিক্ত চাপ। যারা তাদের বাচ্চাদের বলে, তোমাকে যেকোনো মূল্যে জিততে হবে, পারতে হবে। সাফল্য প্রায়ই এই শিশুশিক্ষার্থীদের জন্য জীবন বা মৃত্যুর বিকল্পের মতো উপস্থাপন করা হয়।’
নীনা বিজয়বর্গ বলেন, অনেক অভিভাবকের কাছে ব্যর্থতার জন্য কোনো জায়গা নেই, তাই নম্বরের জন্য শিক্ষার্থীরা নিজেদের অনুভূতি, আবেগ—সবকিছু বাদ দিয়ে পড়াশোনা করেন।
মেডিকেল কলেজের ভর্তির জন্য কোটায় কোচিং করছিল ঝাড়খন্ডের ১৭ বছর বয়সী এক মেয়েশিক্ষার্থী। গত সেপ্টেম্বরে সে আত্মহত্যা করে। পুলিশ জানায়, ‘আমরা দেখেছি যে মেয়েটি প্রায়ই ডায়েরি লিখত। সে লিখেছিল, “আমি সফল না হয়ে কোটা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরে আমার সব শেষ হয়ে যাবে। আমি জানি যে আমি চলে গেলে আমার মা দুঃখ পাবে এবং হতাশ হবে।’
ওই পড়া কিশোরীর ভালো লাগছিল না। কিশোরীর বাবা স্বীকার করেছেন, তিনি ‘বারবার মেয়েকে বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমার স্ত্রী চায়নি যে সে কোটার কোচিং স্কুল থেকে বাদ পড়ুক এবং বাড়ি ফিরে আসুক। সে (স্ত্রী) ফোনে আমার মেয়েকে বলেছিল যে আমরা কোটায় তার পড়াশোনার জন্য প্রায় ১০ লাখ রুপি খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
অ্যালেনের মতো বড় বড় কোচিং স্কুল তাদের ক্যাম্পাসে ৫০ জনের বেশি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শদাতা ছাড়াও ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন চালু রাখেন। নীনা বিজয়বর্গ বলেছিলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ও বিষণ্নতার লক্ষণগুলো প্রায়ই শিক্ষার্থীদের পিতামাতারা উপেক্ষা করেন। যে কয়েকজন ছাত্র বা ছাত্রী প্রাইভেট ক্লিনিকে পরামর্শ নিতে যান, তাঁরা প্রায়ই মাথার স্কার্ফ, মুখ ঢেকে সানগ্লাস পরে ছদ্মবেশে যান।
মেয়েরা বিশেষভাবে ভয় পান, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেছেন—এ কথা জানাজানি হলে তাঁদের বিয়ের ক্ষেত্রে ঝামেলা হতে পারে।
১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী শ্রী কুমার ভার্মার ভাষ্য, ‘এটি পুরো ভারতের সবচেয়ে চাপের শহর। আপনি যে দিকেই তাকাবেন, দেশের তরুণদের হতাশা অবস্থা দেখতে পাবেন। তাই অনেকেরই স্বপ্ন থাকে একজন চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার এবং সেখানে পড়ার সুযোগ পেতে শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম করেন।
কোটার কোচিং স্কুলগুলোর বছরের ফি প্রায় দেড় লাখ রুপি। এর সঙ্গে খাবার ও থাকার জন্য মাসে প্রায় ৩০ হাজার রুপি খরচ হয়। ফলে অনেক অভিভাবককে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়।
বড় বড় কোচিং সেন্টার ভারতের বড় বড় শহরে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। ১১ বছর থেকেই প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতির জন্য এসব কোচিংয়ে ভর্তি হতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উৎসাহিত করা হয়।
মহারাষ্ট্রের হিঙ্গোলির একটি দরিদ্র গ্রামের কৃষক কেদার কোর্দে। গত বছর তাঁর একমাত্র সম্বল খেতের জমি বিক্রি করে পরিবারসহ কোটায় গেছেন। লক্ষ্য ১৪ ও ১৭ বছর বয়সী দুই ছেলেকে অ্যালেন কোচিংয়ে পড়ানো।
‘আমার ছেলেরাই আমার সবকিছু। আমি তাদের সর্বোত্তম শিক্ষা দিতে চাই, তাই কোটায় এসেছি’, বলছিলেন কেদার কোর্দে। তিনি বলেন, ‘জমি বিক্রির সময় খুব দুঃখ পেয়েছি। কারণ, এটিই ছিল আমার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস। তবে আমার ছেলেরা আমার মতো ক্ষুদ্র কৃষকদের মতো দুর্দশার জীবন পাবে না।’
কেদার কোর্দে কোটায় হোস্টেলের নিরাপত্তা প্রহরীর একটি চাকরি জুটে নিয়েছিলেন। তাঁর চারজনের পরিবার একটি ছোট ঘরে সেখানে থাকে। কারণ, তাঁর বড় ছেলে মেডিকেল কলেজের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে কোর্দে যা বেতন পান, তাতে ছেলের পড়াশোনার খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
তাই আবার মহারাষ্ট্রে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন কেদার। এখন আশ্রয় নিয়েছেন বাবা রামদাসের কাছে। ধীরে ধীরে রামদাসের জমি বিক্রিও শুরু হয়েছে নাতিদের পড়াশোনার অর্থ জোগাতে।
৬৯ বছর বয়সী রামদাস কোর্দে বলেছিলেন, ‘আমি সপ্তম শ্রেণিতে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই আমার নাতির শিক্ষার জন্য কোনো অনিচ্ছা ছাড়াই কৃষিজমি বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আশা করি, ডাক্তার বা প্রকৌশলী হিসেবে তারা ফিরে আসবে।’