চীনের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা মান্দারিন। বছর দশেক আগেও মনে করা হতো, ভবিষ্যতে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ এ ভাষাতেই কথা বলবে। ২০১৫ সালে বারাক ওবামা (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট) সরকার যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীকে ২০২০ সালের মধ্যে মান্দারিন ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। ২০১৬ সালে নিজেদের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য যুক্তরাজ্যও তাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নেয়। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং এর প্রভার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মান্দারিন ভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে শুরু করেছিল তখন। কিন্তু এক দশকে সেই ভাষা শিক্ষার প্রতি ও ভাষার প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়ছে। বলা হচ্ছে, চীনের শিক্ষার্থী এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভাষা পড়ার আগ্রহ কমছে। মান্দারিন ভাষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেন কমেছে, তা দেখার চেষ্টা করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।
একসময় ইংরেজি ভাষাভাষীর অনেক দেশে মান্দারিন ভাষা শেখানো চর্চা শুরু হয়েছিল। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রেয় মান্দারিন ভাষায় কোর্সের সংখ্যা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ভাষা শেখানোর প্রতিষ্ঠান মডার্ন ল্যাংগুয়েজ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মান্দারিন ভাষা শেখার কোর্সগুলোর সংখ্যা ২১ শতাংশ কমে যায়। হাইয়ার এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ব্রিটেনে চাইনিজ শিক্ষা কার্যক্রমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৩১ শতাংশ কমে গেছে। (তবে যাঁরা মান্দারিনকে ডিগ্রি কোর্সের অংশ হিসেবে পড়ছেন, তাঁরা এ হিসেবের বাইরে।)
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড চীনের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও দেশ দুটির স্থানীয় নাগরিকদের মান্দারিন ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মান্দারিন ভাষার কোর্সের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কমে এসেছে। জার্মানিসহ নর্ডিক দেশগুলোর দৃশ্যও প্রায়ই একই রকম।
গুগল ট্রান্সলেট ও চ্যাটজিপিটির মতো টুলসগুলোর জন্য মান্দারিন ভাষা দক্ষতায় আর শেখার আর তেমন প্রয়োজন নেইজেনিফার লিউ, মান্দারিন প্রোগ্রাম পরিচালক, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
এটা নিশ্চিত যে আধুনিক ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমতে শুরু করেছে। শিক্ষার্থীরা ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিশ্বের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক বিষয়ের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও মান্দারিন ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ দ্রুত হ্রাস পেয়েছ।
শিক্ষাবিষয়ক এজেন্টদের ২০১৬ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপ অনুসারে, মান্দারিন পড়া ও শেখার সবচেয়ে ভালো কারণ ছিল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা উন্নত করা। সেই সময়ে সামান্য মান্দারিন ভাষা শেখাও অনেক কাজে দিত। ল্যাংগুয়েজ কানেক্টস ফাউন্ডেশন একটি লবিস্ট গ্রুপ। এদের মতে, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ভাষার দক্ষতার কারণে চাকরি পাওয়া মানুষের সংখ্যা ২৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই সময়ে আমেরিকান বিভিন্ন সংস্থা স্প্যানিশ বাদে অন্য যেকোনো বিদেশি ভাষার চেয়ে মান্দারিনভাষী কর্মীদের নিয়োগ দিত। কিন্তু এর পর থেকে এটি কমতে শুরু করে। শিক্ষার্থীদের মধ্য চীনের ভাষা শেখার আগ্রহ কমে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মান্দারিন প্রোগ্রাম পরিচালক জেনিফার লিউ। তিনি বলছেন, আন্তর্জাতিক বিষয় এবং নিরাপত্তা বিষয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তুলনায় গত এক দশকে ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়ুয়াদের সংখ্যা কমে গেছে। এটা হতে পারে, বাজারে পরিবর্তন এসেছে। গুগল ট্রান্সলেট ও চ্যাটজিপিটির মতো টুলসগুলো এত ভালো কাজ করছে যে অল্প স্তরের মান্দারিন ভাষা দক্ষতার জন্য শেখার আর তেমন প্রয়োজন নেই। এদিকে বাজার আরও প্রতিযোগিতামূলক হতে শুরু করল। অনেক ভাষা জানা চীনা গ্র্যাজুয়েটরা মান্দারিন ভাষার জন্য অনেক চাকরি করে যাচ্ছেন। ভাষার দক্ষতার ক্ষেত্রে, তারা অনেক সময়ই তাদের পশ্চিমা সহকর্মীদের চেয়ে বেশি যোগ্য। চীনের শিশুরা ৮ বছর বয়সে ইংরেজি শিখতে শুরু করে। চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার জন্য যে পরীক্ষা, তাতে উচ্চ স্তরের দক্ষতা প্রয়োজন হয়।
বেইজিং অলিম্পিকের সময়ে মান্দারিন ভাষা শেখার আগ্রহ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সি চিন পিংয়ের সময়ে চীন ও হংকংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিবেদন গণমাধ্যমে আসার ফলে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেড়েছে। আর ‘বিটিএস’, ‘প্যারাসাইট’, ‘স্কুইড গেম’ কোরিয়াকে নতুন করে তুলে ধরেছে। শুধু বিনোদনের কারণে ডুয়োলিঙ্গতে মান্দারিনের চেয়ে এগিয়ে কোরিয়ান ভাষা।
পশ্চিমের শিক্ষার্থীদেরও চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার ইচ্ছা রয়েছে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের সময়ে মান্দারিন ভাষা শেখার আগ্রহ শুরু হয়েছিল। তার পর থেকে যদিও প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অধীন চীন আরও নিপীড়ক হয়ে উঠেছে। চীন ও হংকংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিবেদনগুলো গণমাধ্যমে আসতে শুরু করার ফলে বেশির ভাগ ধনী দেশে চীন সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেড়েছে। একই সময়ে চীনের সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলোর নানা কারণে উত্তেজনা বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতারা এখন চীনের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ‘ঝুঁকিমুক্ত করার’ কথা বলছেন। হার্ভার্ডের জেমস গেথিন ইভান্স মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে শুরুর পরই চীনের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হতে শুরু করে। ব্যাপারটি শিক্ষার্থীদের পছন্দকেও প্রভাবিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির সেটন হল ইউনিভার্সিটির চেন ডংডং বলেছেন, অনেকেই এখন মান্দারিন ভাষা পড়ার কোনো মানেই খুঁজে পান না। ফলে, গত ১০ বছরে মান্দারিন ভাষার নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। আমেরিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যও এ প্রবণতা দেখা গেছে।
২০১১ সালের দিকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আমেরিকান শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকলেও বর্তমানে তা অনেক কমে গেছে। এর অন্যতম একটা কারণ হতে পারে দূষণের প্রভাব। ওই সময়ে পশ্চিমের গণমাধ্যমগুলোয় বেনজিংয়ের বায়ুদূষণ নিয়ে নানা খবর প্রকাশ করত।
ভাষা দেশের শক্তিকে তুলে ধরে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটিএস। দেশটির ‘প্যারাসাইট’ অস্কারজয়ী সিনেমা এবং ‘স্কুইড গেম’ একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন শো। এ সব কোরিয়াকে অনেকের কাছে নতুন করে তুলে ধরেছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল—এই ৫ বছরের মধ্যে শুধু বিনোদনের কারণেই আমেরিকায় কোরিয়ান ভাষা শিক্ষার হার ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ভাষা শেখার অ্যাপ ডুয়োলিঙ্গতে মান্দারিনের চেয়ে এগিয়ে গেছে কোরিয়ান ভাষা।
তুলনামূলকভাবে এ জায়গায় চীন অনেকটাই পিছিয়ে আছে। তাদের বিনোদনজগৎ সমাজতান্ত্রিক দলের প্রভাবে পরিচালিত। এ কারণে তাদের তৈরি কনটেন্টগুলো পশ্চিমা দেশের তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোর কাছে বেশি পৌঁছায়। এসব দেশের কাছে মান্দারিন ভাষার জনপ্রিয়তা রয়েছে।
সর্বশেষ এক তথ্য অনুসারে ২০১৮ সালের আফ্রিকায় ৮১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছিল। অনেকেই চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়ছিল। এসব কোর্সের মধ্যে মান্দারিন ভাষার সঙ্গে পরিচিতি এবং চীনা সংস্কৃতিও শেখানো হয়। কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলো চীনের ভাষা শেখানো ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছে। একসময় পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট বেশ সক্রিয় ছিল। তারা সেখানে সস্তায় মান্দারিন ভাষার শিক্ষক সরবরাহ করত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে সামনে আনার অভিযোগ উঠেছিল। ফলে ২০১৭ সালের পর থেকে ১০০টিরও বেশি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটকে বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
যদিও পশ্চিমা সরকারগুলো বলে আসছে যে তাদের উন্নত মান্দারিন ভাষায় দক্ষতাসহ আরও লোকের প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, সিআইএ মান্দারিন জানা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মান্দারিনকে ‘কঠিন বা জটিল ভাষা’ বলে মনে করে। সাম্প্রতিক এক সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের বিষয়ে দক্ষতা এবং তার প্রধান ভাষায় কথা বলার ক্ষমতায় পিছিয়ে আছে ব্রিটেন। একই ভাষ্য জার্মান সরকারেরও। যাঁরা মান্দারিন ভাষা শেখেন, তাঁরা ভবিষ্যতে গুপ্তচর ও কূটনীতিক হতে পারেন বলে মনে করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে ও পশ্চিমের দেশগুলো। এটি চীন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে একে অপরকে ভুল বোঝার ক্ষেত্র আরও সহায়ক হচ্ছে।