একটি প্রবাদ আছে, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর।’ শিক্ষকদের যেকোনো সুবিধা চাইলে একটা অভিযোগ চারদিক থেকে আসে, তা হলো শিক্ষার্থীদের আগে রিডিং শেখান। বাইরের সাধারণ মানুষ বললেও মনকে একটা সান্ত্বনা দেওয়া যেত। খোদ আমাদের নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এই অভিযোগ শিক্ষকের ওপর ঢালাওভাবে এনে একধরনের মানসিক তৃপ্তি ও দায়মুক্তি অনুভব করেন। প্রাথমিক শিক্ষার ওপর মানুষের নেতিবাচক ধারণার দায় কি শুধুই শিক্ষকের?
কয়েক বছর ধরে সরকার অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের একটা ধারণা দিয়েছে যে এখানে পড়ালেখা কম করলেও চলবে। ‘পরীক্ষা’ জিনিসটাকে বিগত সরকারের বুদ্ধিজীবীরা আতঙ্ক হিসেবে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। সরকার সে মতোই শিক্ষাক্রম থেকে মূল্যায়নের ব্যবস্থা পর্যন্ত সবকিছু সাজিয়েছিল। যেখানে বাস্তবতার নিরিখে কার্যকর কোনো শিখনফল অর্জনের উপায় রাখা হয়নি।
এমনও শোনা গেছে যে টাকা ব্যয় করার আর কোনো উপায় না থাকায় একটা মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছে! সেটা এতটাই উদ্ভট যে নিজেরাই সেটা বাতিল করেছে। এখন প্রাথমিকের শিশুরাও বুঝে যে তাদের আসলে পড়ালেখা কম করলেও চলবে। পুরো সিস্টেম যেখানে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা’ করে রাখা হয়েছে, তেমনি এর প্রভাবও শিক্ষকের ওপর পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকের তো শ্রেণি পাঠদান ছাড়া প্রাথমিকের নীতিনির্ধারণীতে (পলিসি মেকিং) আর কোথাও যুক্ত করা হয় না। তাহলে রিডিং না পারার সব দায়ভার কেন শিক্ষকের ওপর বর্তায়? এমন সিস্টেম কেন রেখেছেন, যেখানে শিক্ষক দিয়ে আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না?
‘শতভাগ পাস’ করানো, ‘অটো পাস’ এসব থিওরি কাদের চাপানো? এসব কারণে সরকারি প্রাথমিকের ওপর অভিভাবকেরা আস্থা হারিয়েছেন। দেশের অসংখ্য বিদ্যালয় চলছে অপর্যাপ্ত শিক্ষক দিয়ে। সেখানে কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন করানো একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে শিক্ষকদের ভ্যাংচানো কর্মকর্তারা নিজেরা পরীক্ষামূলকভাবে দুই মাসের জন্য সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন চাইলে!
দেশে একসময় যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন ছিল না। তাই আলাদা এটির সঙ্গে তুলনা করে প্রাথমিকের পিণ্ডি চটকানোর দরকার পড়েনি। তাদের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, তারা পারলে প্রাথমিকের শিক্ষকেরা কেন পারবেন না? বড়ই ভালো প্রশ্ন! আমি বলি, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার নীতিবিরোধী। কারণ, আমরা যে নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে সরকারি প্রাথমিক চালাই, সেখানে তাদের সেই বাধ্যবাধকতা নেই। সেখানে কোনো অসচেতন অভিভাবকের সন্তানের ভর্তির সুযোগ নেই।
সেখানে ভর্তির প্রথম শর্ত ‘পরিবার’। সরকার প্রতি ঘণ্টায় যে নির্দেশনা দেয় শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন নিয়ে, সেটি তাদের মানতে হয় না। সেখানে মূলত শিশুদের চেয়ে অভিভাবকেরাই ফলাফল এনে দেয়! আর এসব অভিভাবকদের বাইরে অন্যরা তাদের শিশুদের দেয় প্রাথমিকে। তাদের নিয়েও আমরা যেভাবে পাঠদান করে যাই, তার প্রশংসা করতে অনেকের কষ্ট হয়। সরকারি প্রাথমিকের নীতি অনুসরণ করে চললে দুই দিনে দেশের ৯০ শতাংশ কিন্ডারগার্টেন বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার দায় তাদের নেই। একটা ঘটনা বলি, আমার এলাকায় একটা কিন্ডারগার্টেনে কোনো শিক্ষার্থীর যদি ৫ শতাংশ সম্ভাবনাও থাকে যে সে সমাপনীতে জিপিএ-৫ পাবে না, তবে তার অভিভাবককে ডেকে কাছের কোনো প্রাইমারিতে দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করত। তো এ কিন্ডারগার্টেন নামক স্বর্গীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা মানতে আমাদের কষ্ট হবে। যদি এতই পছন্দ হয় তাদের নিয়মকানুন, তবে কিন্ডারগার্টেনের নীতি প্রাথমিকেও দেন। তা তো দিবেন না।
এবার বলি শিক্ষকদের কি কোনো দায় নেই? অবশ্যই দায় রয়েছে। আমি তো বলি শিক্ষকদের তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর কোয়ালিটি টেস্ট হোক। কারণ, নিয়োগ দিয়ে ছেড়ে দিয়ে তাঁর শিক্ষক হিসেবে যোগ্যতার কিছুই মূল্যায়ন করবেন না, তা হলে যা হওয়ার তা–ই হবে। কারণ, নিয়োগ দেওয়ার সময় পদবি হয়তো শিক্ষক থাকে, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তো গড়ে উঠে অনেক পরে। আপনি যতই ভালো মনে করে নিয়োগ দেন, তিনি শিক্ষক হিসেবে ভালো না–ও হতে পারেন। কোয়ালিটি টেস্ট উৎরাতে পারলে সে মতে সুযোগ–সুবিধাও পাবেন। এ ছাড়া একই প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর এক শিক্ষক থাকলেও ভালো আউটকাম আসবে না। সেটিও নির্দিষ্ট বছর পরপর আশপাশের স্কুলে বদলি করতে হবে। এতে কর্মস্পৃহা বাড়বে বলে মনে করি। আমার অল্প বয়সের শিক্ষকতা জীবনে পাঠদানে অক্ষম একজন শিক্ষকও দেখিনি কিন্তু তাঁদের কর্মস্পৃহা কমে গিয়েছে। এ ছাড়া আর যা যা করলে কর্মস্পৃহা বাড়ে বলে মনে করি, সেটি আর না বলি।
কারণ, সেগুলোতে অনেকের গাত্রদাহ হয়। এই যে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না, সেটার পেছনে নিশ্চয় শিক্ষক দায়ী নন। কারণ, শিক্ষক নিজের যোগ্যতা নিজে নির্ধারণ করে চাকরিতে আসেননি। যাঁরা হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে ছড়ি ঘোরান, তাঁদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। যাঁদের দিয়ে প্রাথমিকের শতভাগ বাস্তবায়ন করাবেন প্রাথমিকের শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে, তাঁদের প্রতিনিধি রাখলে জাত যাবে না। তাঁরাও এ সেক্টরের ভালোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
লেখক: নাসিম আহমেদ, সহকারী শিক্ষক, হায়াতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাগমারা, রাজশাহী