স্কুলে শিক্ষকের হাতে মার খাওয়া পাকিস্তানের সিস্টার জেফই বিশ্বের সেরা শিক্ষকের তালিকায়

‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’-এ সেরা দশে আছেন পাকিস্তানের সিস্টার জেফ
ছবি: ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’ ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বিশ্বের সেরা শিক্ষকদের একটি তালিকায় জায়গা পেয়েছেন পাকিস্তানের শিক্ষক সিস্টার জেফ। এখন বিশ্বের সেরা শিক্ষকের মনোনয়নের তালিকায় সেরা দশে আছেন তিনি। ইউনেসকো-সমর্থিত ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’-এর আওতায় বিশ্বের সেরা শিক্ষকের পুরস্কারের মূল্য এক মিলিয়ন ডলার।

‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’-এর খবরে বলা হয়েছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য গ্লোবাল টিচার প্রাইজ দেওয়া হয়ে থাকে। গ্লোবাল টিচার প্রাইজ ২০২৩-এর ১০ ফাইনালিস্টের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন পাকিস্তানের সিস্টার জেফ। ১৩০টি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষাবিদেরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে সবাইকে পেছনে ফেলে ১০ ফাইনালিস্টের তালিকায় উঠে এসেছেন তিনি।

নিজ বাড়িতে পড়াচ্ছেন পাকিস্তানের সিস্টার জেফ

সিস্টার জেফের জন্ম পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায়। পড়া কম পারায় ছোটবেলায় স্কুলে শিক্ষকের হাতে নিয়মিত মার খেতেন সিস্টার জেফ। লাঞ্ছনাও সইতে হয়েছে সহপাঠীদের সামনে। এসবের পরে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাড়িতেই শুরু করেন নিজে নিজে পড়াশোনা। সঙ্গে স্থানীয় শিশুদের টিউশন দিতেন। অল্প বয়সেই বিনা মূল্যে শিক্ষাদানের জন্য স্কুল খোলেন। শিক্ষার্থী জোগাড়ের জন্য এ বাড়ি–ও বাড়ি ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। তিনি বলেন, যদিও তাঁর স্কুলে মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল, কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য সম্মান, সমতা, ভালোবাসা ও আবেগ ছিল। এই আবেগই ভবিষ্যতে ইতিহাস তৈরি করেছে।

সিস্টার জেফের জীবনকাহিনি করুণ। কঠোর পরিশ্রমের ফলেই এমন জায়গায় তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রাইভেটে ছাত্রী হিসেবে পড়েছেন। দিনে আট ঘণ্টা কাজ করতেন। নিজের স্কুলে চার ঘণ্টা পড়াতেন। নিজের পড়াশোনার জন্য সময় বেছে নিতেন রাতে। পড়তেন চার ঘণ্টা। জ্ঞান ও কথা বলার দক্ষতা বাড়াতে তিনি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন এবং ইংরেজি খবর শুনতেন। সে সময় তিনিই তাঁর পরিবারে বা পাড়ায় একমাত্র শিক্ষিত ছিলেন। ২৬ বছর ধরে করছেন শিক্ষকতা। এখন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন।

শিশুশিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিস্টার জেফ

নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য ২০০৬ সালে বন্দুকধারীরা সিস্টার জেফের বাড়িতে আক্রমণ করেছিল। এর ফলে পরিবারের সঙ্গে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। ছয় মাস পর পরিবারসহ ফেরেন গ্রামে। সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষার্থীদের ফেলে আর কখনো কোথায় যাবেন না। ২০১০ সালে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তখন তাঁর স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক।

‘যত দিন আমি বেঁচে আছি, বিশ্বের শিশুদের শিক্ষিত করার জন্য কাজ করে যাব।’
সিস্টার জেফ

সিস্টার জেফ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট থেকে শিখছেন, যা শিখছেন তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জ্ঞান ভাগ করে নিচ্ছেন। কোনো আনুষ্ঠানিক আইটি প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি গুগলকে তাঁর শিক্ষক বানিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি লিন সিমস গ্লোবাল প্রাইজ জেতেন। পুরস্কারের অর্থে ছোট জমি কিনেছিলেন। এ জায়গায় তিনি সকালে নারীদের বিনা মূল্যে কাজ শেখানো শুরু করেন। আর সন্ধ্যায় তাঁর শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। পড়াশোনা শেষে এদের অনেকেই এখন তাঁর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে। তাঁর অনেক শিক্ষার্থী জীবনে সফলতা পেয়েছেন। অনেকে অপরাধবিজ্ঞান, বিবিএ, মানবসম্পদ, মার্কেটিং, ফিন্যান্স এবং গণযোগাযোগে মাস্টার্স করছেন। এই ২৬ বছরে সিস্টার জেফ শতাধিক শিশুকে শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমানে ২১৫ সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে বিনা মূল্যে শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠান জেডডব্লিউইই ফাউন্ডেশনে (সেফানিয়া ফ্রি এডুকেশন অ্যান্ড উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশন) ২৬ কর্মচারী রয়েছেন। সেফানিয়া ফ্রি এডুকেশন অ্যান্ড উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বাড়ানো। এই ২৬ কর্মচারীর সবাই তাঁর প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

সিস্টার জেফ তাঁর জীবনকে শিক্ষার জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি সব সময় বলেন, ‘যত দিন আমি বেঁচে আছি, বিশ্বের শিশুদের শিক্ষিত করার জন্য কাজ করে যাব।’

২৬ বছর ধরে সিস্টার জেফ শতাধিক শিশুকে শিক্ষা দিয়েছেন

একজন নারী শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, পরিবেশগত নেত্রী, শিশু অধিকার কর্মী, লেখক, আন্তর্জাতিক বক্তা এবং আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে সমাদৃত সিস্টার জেফ। তিনি জেডডব্লিউইই এবং জেফ সানডে স্কুল মিনিস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসনও। সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য তাঁর কাজ এবং উৎসর্গের জন্য তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনালের ইটারনাল লাইফ মিনিস্ট্রি কর্তৃক অসামান্য পারফরম্যান্স পুরস্কার এবং বায়োনিয়ার্স চেঞ্জ মেকারস অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। চ্যানেল নিউজ এশিয়া সিঙ্গাপুর তাঁর জীবন এবং কাজের ওপর ফ্লাইট অব দ্য ফ্যালকনস চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। ছবিটি ২০১৬ সালে নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে স্বর্ণপদক জিতেছিল। ২০২১ সালে কার-ই-খাইর পাকিস্তান থেকে তাঁকে মানবতার বই হিসেবে একটি স্বর্ণপদক এবং পাকিস্তানের ভিক্টরি চার্চ থেকে একটি অসামান্য পারফরম্যান্স পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী নানা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

সেরা দশে পাকিস্তানের সিস্টার জেফ ছাড়া ভারত, ঘানা, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, কানাডা ও ইউক্রেনের শিক্ষকও আছেন। আগামী ৮ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেসকোর ৪২তম জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে বিশ্বের সেরা শিক্ষককে বেছে নেওয়া হবে।