আদর্শ শিক্ষার্থীই পারেন ভবিষ্যতে দেশকে সঠিক সেবা দিতে

একজন ভালো পাইলট পারেন প্রতিকূল পরিস্থিতি দক্ষ হাতে সামলে নিয়ে উড়োজাহাজকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। তেমনি একজন দক্ষ মাঝি উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যেও শক্ত হাতে নৌকাকে নিয়ে যান তীরে। একটি দেশের সব ধরনের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন বর্তমানের শিক্ষার্থীরা। তাই তাঁদের সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা বাঞ্ছনীয়। যে শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে দেশের ও মানুষের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুতের প্রক্রিয়ায় রেখেছেন, তাঁরাই আদর্শ শিক্ষার্থী।

আমরা দেখি, শুধু স্কুলপর্যায়েই দেশপ্রেম বা নৈতিক বিষয় শেখানো হয়, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাঁদের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চপর্যায়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে যতই তাঁদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করুক, দেশের জন্য কাজ করার বোধ যদি না জন্মায়, তাহলে সেই জ্ঞান কোনো কাজেই আসবে না, যার নানা প্রমাণ আমরা বর্তমানে সমাজের দিকে তাকালে সহজেই বুঝতে পারি।

একজন মানুষ তাঁর পরিপূর্ণতা পান, যখন তাঁর মনের সচেতনতা ধরে রাখতে পারেন। মনের সচেতনতার ক্ষমতা আসলে বিশাল। একজন মানুষ যখন সচেতন থাকতে পারেন, তখন তাঁর করণীয় এবং বর্জনীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

বর্তমানে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেককেই দেখি তাঁরা তাঁদের করণীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অসচেতন। পড়াশোনা এবং কাজে নিজের মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, সফলতার জন্য মনোযোগ ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ছাত্রজীবনে। শিক্ষার্থীদের মনোবিক্ষিপ্ততা বর্তমান সময়ে এক মহামারী রূপ নিয়েছে। তাঁরা হয়ে পড়ছেন বিষণ্ন, কর্মবিমুখ এবং হতাশ।

অলসতায় তাঁদের কাজে দীর্ঘসূত্রতা চলে আসছে, তাঁরা সময়মতো সঠিক কাজটি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে না পারায় তাঁরা শুধু পড়াশোনা ও কাজের পেছনেই ছুটে যাচ্ছেন, লেখাপড়ার আনন্দ পাওয়া থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত। লেখাপড়াকে একধরনের বোঝা ও চাপ হিসেবে অনুভব করছেন।  

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জালে তাঁরা প্রতিমুহূর্তে বন্দী হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীভাবে অনলাইনে পার করছেন, তা টেরই পাচ্ছেন না। অনেকেই মনে করছেন, এটা একটা বিনোদন।

কিন্তু তাঁর সামর্থ্য, মেধা ও সময় অপচয় হয়ে যাচ্ছে নীরবে। এর ফলে শুধু যে মূল্যবান সময়ই অপচয় হচ্ছে, তা নয় বরং তাঁরা শারীরিক এবং মানসিক শক্তিকে ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে দিচ্ছেন। অনেকেই অসুস্থ আচরণ, অবৈধ সম্পর্ক এবং অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে জীবনকে করে তুলছেন জটিল।
সহপাঠীদের সবাই বন্ধু হয় না, বন্ধু নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সচেতন থাকা প্রয়োজন। জীবনধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সহযোগিতার জন্য, পাশে থাকার জন্য ভালো বন্ধুর বিকল্প নেই।

শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য বন্ধু এবং পরিবারের সবার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য। সম্পর্কের মধ্যে মান–অভিমান, ভুল–বোঝাবুঝি থাকবেই কিন্তু আমরা যেন সম্পর্কের সীমা অতিক্রম না করি। আমাদের এই জীবনকে কী দেব এবং জীবন থেকে কী পাব—সবারই সেই ধারণাটা পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন।  

বন্ধুদের প্ররোচনায়, কখনো অতি উৎসাহে বা কখনো হতাশায় আমাদের শিক্ষার্থীরা ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। এই দশকে  ধূমপানের আধুনিক রূপ হচ্ছে ভেপিং বা ই-সিগারেট। বর্তমানে একটা জিনিস লক্ষণীয়, রাস্তার মোড়ে কলেজ এমনকি স্কুল ড্রেস পরা ছেলেমেয়েরা পথচারীদের সামনেই ভেপিং করছেন। এতে কৃত্রিম হালকা মিষ্টি সুগন্ধি ব্যবহৃত হয় বলে এটাকে মনে হয় খুব উপভোগ্য। কিন্তু ভেপিংয়ের ভয়াবহতা আমাদের নতুন প্রজন্ম জানে না বললেই চলে। এ ধরনের ভেপিংয়ের মেশিনের ভেতরে তরল নিকোটিন ও গাজার নির্যাস থাকে, তার সঙ্গে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক কেমিক্যাল, যা গলা, মুখ, মাড়ি ও ফুসফুসের ক্যানসার তৈরি করতে পারে।  

তাঁরাই সফলতা অর্জন করেন, যাঁরা নিজেদের সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে মুক্ত রাখতে পারেন। এই যে নিজেকে বিরত রাখার শক্তি বা সচেতনতা—এটাই জীবনকে করে সমৃদ্ধ। কেউ আমাকে বললেই সেই কাজটি করে ফেলব, ডাকলেই সেখানে যাব নাকি প্রতিমুহূর্তের প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্ত আমার পছন্দমতোই হবে—যা তৈরি করবে আমার ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পারলেই আমরা আমাদের জীবনের লক্ষ্যের পথে এগোতে পারব।      

পরীক্ষার আগে আগে সিলেবাস শেষ করব—এই ভুল ভাবনা থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে হবে। প্রতিদিন নিজের কাজের জন্য একটা সহজে অনুসরণীয় রুটিন ফলো করা দরকার। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি কাজে শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে হবে। কারণ, শৃঙ্খলাই সফলতার পথ তৈরি করে।

অন্যদিকে, শিক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সামনে দেশের জন্য কাজ করার উজ্জ্বল ও আদর্শের দিক তুলে ধরা। যাঁরা দেশের জন্য নীরবে কাজ করেছেন, তাঁদের জীবনী, তাঁদের কর্মপ্রণালি বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে তাঁদের সামনে তুলে ধরতে হবে। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করার আগ্রহ বা উপলব্ধি যদি শিক্ষার্থীদের না দিতে পারি, মানুষকে সেবা দেওয়ার শিক্ষা দিতে যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য যেন অনেকাংশেই মিছে হয়ে যায়।

আমাদের জীবনটা একেবারে মসৃণ নয়। জীবনের একেক সময় একেকভাবে কাটবে, কখনো সুখ আবার কখনো কঠিন সময় পার করতে হয়। জীবনে যখন চ্যালেঞ্জ আসে, তা কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়—এই শিক্ষা আমাদের সন্তানদের আছি কি না, সে বিষয়ে অনেক অভিভাবকই বেখেয়ালি। ফলে দেখা যাচ্ছে, ছোট কোনো মানসিক আঘাত বা জীবনের সামান্যতম প্রতিকূলতা  তাঁরা মোকাবিলা করতে পারছেন না। পরিণামে নিজের জীবনকে নানাভাবে হুমকির মুখে ফেলছে। মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা আমরা তাদের দিতে পারছি না বলেই মন যা করতে বলে তাঁরা তা–ই করে বসছেন।

এসব থেকে উত্তরণের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগ ও তাদের সুনিয়ন্ত্রিত জীবনের জন্য প্রথমেই আমাদের পরিবারের সবাইকে পরস্পরের সঙ্গে প্রাণবন্ত এবং অকপটে সব কথা বলার মতো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। মা-বাবাকে এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত মমতা ও ধৈর্যের সঙ্গে সন্তানদের পাশে বন্ধুর মতো থাকতে হবে, কখনো তাদের কৃতকর্মের জন্য হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না।

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের নিজ নিজ বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের মতো দায়িত্বশীল ভূমিকায় থাকতে হবে এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য পরামর্শ প্রদান করতে হবে।

পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও রাষ্ট্র সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনুকূল ও আনন্দদায়ক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলেই তারা সততার সঙ্গে দেশের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। আমরা চাই প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য হোক কর্মক্ষেত্রে গিয়ে দেশের মানুষকে সাহায্য করা ও সেবা দেওয়া।

* লেখক: আবুল হাসনাত রোবেল, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা