রাজধানীর শেরেবাংলা বালক স্কুলের পাশে যে ফুটপাত আছে, সেখানে বেশ কিছু অস্থায়ী চায়ের দোকান। দোকানের ফাঁকে ফাঁকে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে প্রকাশ্যই শিশু–কিশোরেরা চা-সিগারেট খাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে স্কুলের পোশাক পরা কয়েক শিশু-কিশোর এসে দোকানদারের কাছে নাম ধরে একটি ব্র্যান্ডের সিগারেট চাইল। দোকানের ওপরেই প্যাকেট–সংবলিত চিহ্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এ দোকানে সিগারেট পাওয়া যায়। আলাদা করে আর জিজ্ঞাসা করতে হয় না—সিগারেট আছে কি না।
দোকানদানদের একজনকে এভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে সিগারেট বিক্রি অপরাধ কি না, জানতে চাইলে একজন দোকানদার বলেন, ‘এটা দেখেই তো বোঝে, আমাগো কাছে সিগারেট আছে। আর এতে তো আমি কোনো অপরাধ দেহি না। যার লাগব নিব। যে খাওয়ার এমনেই খাইব। বিজ্ঞাপন থাকলে সুবিধা হয় আরকি যে আমার দোকানে মালডা আছে।’
অথচ বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ধারা ৬ক অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে কারও কাছে অথবা কারও দ্বারা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনের এ বিধান লঙ্ঘন করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের বিক্রির পাশাপাশি বিজ্ঞাপনও দেখানো হচ্ছে। তবে এদিকে কারও নজর নেই। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তির ব্যবহারে তামাক আইন বাস্তবায়ন এবং তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শন কমানো সম্ভব। কিন্তু বড় পরিসরে এর কোনো প্রয়োগ নেই।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নীহার রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের আকৃষ্ট করতে স্কুলের আশপাশে যেভাবে সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখা যায়, তা দুঃখজনক। এটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে শিশু-কিশোরদের সিগারেট খাওয়ার হার কমে আসত। এ দিকে আমাদের নজর দেওয়া জরুরি। শিশু-কিশোরদের নানা জটিল অসুখবিসুখের শুরুটা হয় সিগারেটের মাধ্যমে। আর এটি থেকেই অন্য নেশার দিকে শিশু-কিশোরদের যাওয়ার রেকর্ড বেশ জোরালো।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের গ্লোবাল অ্যাডাল্টস টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধূমপায়ী বা তামাক সেবনকারীদের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ। আর টোব্যাকো অ্যাটলাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০-১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৬ শতাংশ।
২০১৬ সালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মোট ১১০টি বিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা চালায়। এতে বিদ্যালয়ের ১০০ মিটারের মধ্যে থাকা মোট ৫০৭টি মুদিদোকানের ৪৮৭টিতেই অন্য পণ্যের পাশাপাশি তামাকদ্রব্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
তামাক কোম্পানি তামাকপণ্য প্রদর্শনকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট বা মোড়কের ডিজাইনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমনকি বিক্রয়কেন্দ্রে দৃশ্যমান স্থানে তামাকপণ্যের প্যাকেট সাজিয়ে রাখতে তারা বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করে থাকে। এতে তামাক কোম্পানি শিশু-কিশোরদের টার্গেট করে ক্যাম্পেইনের সুযোগ পায়। টোব্যাকো অ্যাটলাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬ শতাংশ।
একটি সমীক্ষায় ঢাকার স্কুলগুলোর আশপাশে প্রায় ৭৫ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে কোনো না কোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন এবং ৩০ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে শিশুদের চোখ বরাবর স্থানে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। ঢাকার ৭৬ শতাংশ পয়েন্ট অব সেল বা বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন করা হয়। ফলে শিশু-কিশোরেরা তামাকপণ্যের ব্যবহার শুরু করতে উৎসাহিত হয়। শিশুদের প্রলুব্ধ করতে প্রায়ই তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট বা মোড়ক শিশুদের প্রিয় খাবার যেমন ক্যান্ডি, চকলেট প্রভৃতির পাশে বা দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখা হয়। বাংলাদেশে স্কুল ও খেলার মাঠের আশপাশে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় ৬৪ দশমিক ১৯ শতাংশ বিক্রয়স্থলে ক্যান্ডি, চকলেট বা খেলনার পাশে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
নরওয়ের একটি গবেষণায় বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন দেখে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কিশোরদের মধ্যে সিগারেট ক্রয়ে উৎসাহিত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। নিউজিল্যান্ডেও বিক্রয়স্থলে বেশি মাত্রায় তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন দেখে ধূমপান শুরু করতে উৎসাহিত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। অস্ট্রেলিয়ায় এক-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন দেখে সিগারেট ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছে।
খসড়া সংশোধনী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমানার মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য নিষিদ্ধসংক্রান্ত প্রস্তাব
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত, ওয়েবসাইটে প্রকাশ, অংশীজনের মতামত গ্রহণ এবং আন্তমন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য ক্যাবিনেট ডিভিশনে প্রেরণ করেছে। খসড়া সংশোধনীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সীমানার পরিধি বৃদ্ধির প্রস্তাব খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনের এ বিধান লঙ্ঘনে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।
খসড়া সংশোধনীতে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের কোনো ধরনের প্যাকেট, কৌটা, খালি বা নমুনা বা মোড়ক প্রদর্শনসহ যেকোনো উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্রেতার নিকট বিক্রয়ের সময় ব্যতীত বিক্রয়স্থলে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য বা এর মোড়ক বা প্যাকেট দৃষ্টির আড়ালে রাখার প্রস্তাব খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আইনের এ বিধান লঙ্ঘন করলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।
গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন বন্ধ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধের প্রস্তাব–সংবলিত খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত পাস করা গেলে তরুণ প্রজন্ম তামাকের ছোবল থেকে সুরক্ষা পাবে।