চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হল
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হল

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০% শিক্ষার্থীর নেই আবাসিক সুবিধা 

আবাসিক সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীদের খরচের পাশাপাশি অবর্ণনীয় কষ্টও পোহাতে হয়। পড়াশোনায় ব্যাঘাত। 

মাহাতির হাসান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর গ্রামের বাড়ি নড়াইলে। দুই বন্ধু মিলে শান্তিনগরের একটি বাসায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন। দুজনের মধ্যে শুধু তাঁকে ভাড়া বাবদ দিতে হয় ৪ হাজার ২০০ টাকা। এর বাইরে খাওয়ার খরচ আছে। শান্তিনগর থেকে পুরান ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ আনুষঙ্গিক খরচ আছে। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে খরচ হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। 

প্রায় দুই দশক আগে কলেজ থেকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ছাত্রদের জন্য এখনো কোনো আবাসিক হল তৈরি হয়নি। ছাত্রীদের জন্য শুধু একটি আবাসিক হল আছে। মাহাতির হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য আবাসিক হল না থাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। এতে খরচের পাশাপাশি পুরোনো ঢাকার যানজট পেরিয়ে যাতায়াতেও সমস্যায় পড়তে হয়। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ-মাদ্রাসা ছাড়া) অধ্যয়নরত মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ শতাংশের আবাসিক সুবিধা নেই। বাকি ৪০ শতাংশের এই সুবিধা আছে। 

ভালোভাবে থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে ভালোভাবে পড়াশোনা করাও সম্ভব হয় না। আবাসিক সুবিধা সম্প্রসারণের পাশাপাশি মেধা ও চাহিদার ভিত্তিতে হল প্রশাসন যেন শিক্ষার্থীদের হলে ওঠাতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অনেক পরিবারের সন্তানও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা না থাকায় (আবাসিক হল ও সিট কম) শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের ধাক্কা খান। 

■ অধিভুক্ত কলেজ-মাদ্রাসা ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ২,৯২,২৯৬ জন।

■ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৩,৪১,০৯৮ জন। আবাসিক সুবিধা পান শতাংশ। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম

অবশ্য অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে হলে ওঠেন। তবে তাঁরা যেসব কক্ষে ওঠেন (গণরুম নামে পরিচিত) সেখানে পড়াশোনা করার মতো পরিবেশ থাকে না। আবার অনেক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া শেষ হলেও রাজনৈতিক পরিচয়ে হলে থাকেন। অনেক আবাসিক হলের নিয়ন্ত্রণ করেন সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতারা। 

দেশে অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় ১৬৯টি। এর মধ্যে ৫৫টি পাবলিক ও ১১৪টি বেসরকারি। অধিভুক্ত কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ জন।  

নানা বাস্তবতা ও আর্থিক সক্ষমতার অভাবে নতুন হল না করেও বিভাগ ও আসন বাড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত অশুভ রাজনীতি হয় সেগুলো হয় মূলত আবাসিক হলের সিট–কেন্দ্রিক ঘটনার কারণে
মুহাম্মদ আলমগীর, ইউজিসির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব)

আবাসিক সুবিধার পরিস্থিতি

গত অক্টোবরে প্রকাশিত ইউজিসির সর্ব শেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসন–সংকটসহ উচ্চশিক্ষার নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অধিভুক্ত কলেজ-মাদ্রাসা ছাড়া ২০২২ সালে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার ২৯৬ জন। তাঁদের মধ্যে আবাসিক সুবিধা ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৬ জনের। তাদের মধ্যে ৬৮ হাজারের বেশি ছাত্র এবং সাড়ে ৪৯ হাজার ছাত্রী। 

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট আবাসিক হল, হোস্টেল ও ডরমিটরি ছিল ২৫২টি। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরিকল্পিতভাবে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোয় আবাসিক–সংকট তীব্র হয়েছে। 

জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, নানা বাস্তবতা ও আর্থিক সক্ষমতার অভাবে নতুন হল না করেও বিভাগ ও আসন বাড়ানো হয়। তবে তিনি মনে করেন আবাসিক সুবিধা না বাড়িয়ে শিক্ষার্থী বাড়ানো উচিত নয়। এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত অশুভ রাজনীতি হয় সেগুলো হয় মূলত আবাসিক হলের সিট–কেন্দ্রিক ঘটনার কারণে। আবাসিক হলে আসনসংকট না থাকলে এই সমস্যাও হতো না।

সব শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক ব্যবস্থা থাকতে হবে তার বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু দেশের শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য  প্রয়োজন অনুযায়ী আবাসিক ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল পুরোপুরি আবাসিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৫ হাজারের বেশি। ওই বছর ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা ছিল। বাকি ১৮ শতাংশের জন্য ছিল না। 

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ছয়টি হল করা হয়েছে। এখন মোট আবাসিক হলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১। নতুন ছয়টি হলের আসনসংখ্যা ছয় হাজারের মতো। তবে দুটি এখনো চালু হয়নি।

দেশের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা নেই। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৩টি বিভাগ ও ১৩টি ইনস্টিটিউট ছিল। হল ও হোস্টেল মিলিয়ে আবাসিক হল ২৩টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা ছিল।  

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা আছে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর। বাকি শিক্ষার্থীর নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা নেই।

শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধায় পিছিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জে অবস্থিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। 

ইউজিসির তথ্য বলছে, কৃষি ও কৃষিশিক্ষার প্রাধান্য থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তুলনামূলকভাবে আবাসিক সুবিধা বেশি। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর জন্যই আবাসিক সুবিধা ছিল। এ ছাড়া রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৮ শতাংশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক সুবিধা ছিল।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম ছিল। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে ৯৭টি হোস্টেল বা ডরমিটরি রয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক সুবিধা আছে।

দায়িত্ব থাকতে হবে প্রশাসনের

শিক্ষার বাজেট ও শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা থাকা খুবই দরকার। কারণ, শিক্ষার্থীদের বড় অংশই আসেন মফস্‌সল এলাকা থেকে বা দূরদূরান্ত থেকে। অনেকেই দ্বিতীয় বর্ষ বা তৃতীয় বর্ষে গিয়ে আবাসিক হলে থাকার সুযোগ পান। ভালোভাবে থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে ভালোভাবে পড়াশোনা করাও সম্ভব হয় না। আবাসিক সুবিধা সম্প্রসারণের পাশাপাশি মেধা ও চাহিদার ভিত্তিতে হল প্রশাসন যেন শিক্ষার্থীদের হলে ওঠাতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।