জাপান একটি চিত্তাকর্ষক দেশ, যা সারা বিশ্ব থেকে অনেক ছাত্র, কর্মজীবী ও পর্যটকদের স্বাগত জানায়। বিদেশিদের মধ্যে যাঁরা কাজ বা লেখাপড়ার সূত্রে জাপানে থাকার পরিকল্পনা করেন, তাঁদের জন্য জাপানি ভাষা শেখা অনেকটা বাধ্যতামূলক। বর্তমান বিশ্বায়নের এ যুগে যদিও জাপানিদের মধ্যে ইংরেজিতে দক্ষতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারপরও একজন বিদেশি হিসেবে জাপানে বসবাসকালীন স্থানীয় ভাষার ওপর দক্ষতা থাকলে বা অর্জন করতে পারলে তা দৈনন্দিন জীবনকে যেমন সহজ করে, তেমনি এ দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন সহজ হয়।
জাপান-বাংলাদেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। জাপানের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে চলছে। সেই সুবাদে বাংলাদেশে জাপানিদের উপস্থিতি দিন দিন বাড়ছে। পক্ষান্তরে জাপানে জনসংখ্যা হ্রাস ও বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষ কর্মীর ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। কর্মীর ঘাটতি পূরণের জন্য কয়েক বছর আগে থেকে জাপান বিদেশি কর্মী আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জাপান যে কটি দেশ থেকে দক্ষ কর্মী নেয়, বাংলাদেশ তাঁর মধ্যে একটি। কিন্তু বিদেশি কর্মী আসার ক্ষেত্রে অনেক শর্ত রয়েছে। জাপানি ভাষা জানা এসব শর্তের একটি এবং অন্যতম। তাই যাঁরা জাপানে আসার পরিকল্পনা করছেন, তাঁদের প্রথম করণীয় হলো জাপানি ভাষা শিক্ষা ও জাপানি ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করা।
জাপানি ভাষা জানা থাকলে দৈনন্দিন জীবনে যেসব সুবিধা উপভোগ করার সুযোগ হয়, তা জীবনকে আরও আনন্দময় করে তোলে। জাপানের পরিবহনব্যবস্থা অনেক উন্নত। কিন্তু ভাষা জানা না থাকলে এসব উন্নত পরিবহনব্যবস্থা থেকে ন্যূনতম সুবিধা নেওয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে। এ ছাড়া একজন বিদেশি হিসেবে যেখানেই যান না কেন, সবখানেই জাপানি ভাষার দক্ষতার প্রয়োজন হয়
জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা বাংলাদেশিদের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলছে। বাংলাদেশে যাঁদের চাকরি আছে, তাঁরা উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফেরত যান। কিন্তু যাঁদের চাকরি নেই, তাঁদের বেশির ভাগই জাপানে থেকে যেতে চান। কারণ, জাপানের দৈনন্দিন জীবন, শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তা অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে অতুলনীয়। ভাষাগত সমস্যার কারণে কেউ কেউ অন্য দেশে চলে গেলেও একটি বৃহৎ অংশ জাপানে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর এই থেকে যাওয়ার চেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ হলো জাপানি ভাষা শেখা ও দক্ষতা অর্জন করা। ছাত্র হোক বা কর্মজীবী হোক, জাপানি ভাষা জানা না থাকলে প্রত্যেককে নানা রকম অসুবিধায় পড়তে হয়। আজকের লেখায় সেসব অসুবিধার কথা না বলে জাপানি ভাষা জানা থাকলে জাপানে আসার পর কী কী সুবিধা উপভোগ করা যায়, তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বিদেশিদের মধ্যে যাঁরা জাপানি ভাষা জানেন, তাঁরা জাপানি সমাজে আরও কার্যকরভাবে মিশতে পারেন। জাপানি ভাষার দক্ষতা স্থানীয়দের সঙ্গে আরও ভালো যোগাযোগ, অর্থপূর্ণ সংযোগ ও বন্ধুত্ব গড়াকে উৎসাহিত করে। জাপানি ভাষায় কথা বলার মাধ্যমে বিদেশিরা প্রতিদিনের কথোপকথনে নিযুক্ত হতে পারেন, সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা বুঝতে পারেন এবং জাপানের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রশংসা করতে পারেন। এই ভাষাগত ক্ষমতা স্থানীয় জীবনধারা সহজতর করে, জাপানের অবস্থানকে আরও ফলপ্রসূ ও আনন্দদায়ক করে তোলে।
জাপানে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজছেন, এমন বিদেশিদের জন্য জাপানি ভাষা জানা অনেকটা পূর্বশর্ত। অনেক জাপানি কোম্পানি দ্বিভাষিক প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়। কারণ, ভাষা জানা থাকার কারণে একজন বিদেশি জাপানের কর্মসংস্কৃতিসহ স্থানীয় সংস্কৃতি বোঝা এবং একে সম্মান করা ও মেনে চলায় পারদর্শী হন। জাপানি ভাষায় সাবলীলতা চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মুক্ত করে এবং জাপানের মধ্যে ক্যারিয়ারের উন্নতি সাধনে সহায়তা করে। অধিকন্তু কর্মক্ষেত্রে জাপানি ভাষায় কথা বলা কার্যকর টিমওয়ার্ককে উৎসাহিত করে, সহকর্মী ও ক্লায়েন্টের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাড়াতে সহায়ক হয়।
ভাষা ও সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। জাপানি ভাষা শেখার মাধ্যমে বিদেশিরা জাপানি সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ভাষা শিক্ষা জাপানি শিষ্টাচারের সূক্ষ্মতা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যা জাপানি সমাজে অত্যন্ত মূল্যবান। ভাষার জ্ঞান জাপানের ঐতিহ্যগত শিল্প, সাহিত্য ও পারফর্মিং আর্টকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়। ভাষা জানা না থাকলে যা প্রায় অসম্ভব। জাপানে স্থানীয় উৎসব পালনের ঐতিহ্য রয়েছে। জাপানি ভাষা জানা থাকলে এসব স্থানীয় উৎসবে অংশগ্রহণ সহজতর হয়। এতে জাপানের অনন্য ঐতিহ্যের প্রতি সত্যিকারের উপলব্ধি হয়।
জাপানি ভাষা জানা থাকলে দৈনন্দিন জীবনে যেসব সুবিধা উপভোগ করার সুযোগ হয়, তা জীবনকে আরও আনন্দময় করে তোলে। জাপানের পরিবহনব্যবস্থা অনেক উন্নত। কিন্তু ভাষা জানা না থাকলে এসব উন্নত পরিবহনব্যবস্থা থেকে ন্যূনতম সুবিধা নেওয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে। এ ছাড়া একজন বিদেশি হিসেবে যেখানেই যান না কেন, সবখানেই জাপানি ভাষার দক্ষতার প্রয়োজন হয়। রেস্তোরাঁয় খাবারের অর্ডার দেওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা—সবখানেই জাপানি ভাষা জানা জরুরি। জাপানে অবস্থানকালে জাপানি ভাষার দক্ষতা নিজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বাড়ায় এবং যোগাযোগের বাধা কমিয়ে দেয়।
ভাষা একটি সেতু হিসেবে কাজ করে, যা বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে সংযুক্ত করে। জাপানি ভাষায় কথা বলার মাধ্যমে বিদেশিরা স্থানীয়দের সঙ্গে শক্তিশালী সংযোগ গড়ে তুলতে পারেন। জাপানি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি প্রকৃত আগ্রহ প্রদর্শন করা সম্ভব হয়। জাপানি ভাষা শেখার প্রচেষ্টা প্রায়ই জাপানি ব্যক্তিদের দ্বারা প্রশংসিত হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি করে। ভাষার বাধা অতিক্রম করার মাধ্যমে অর্থপূর্ণ আন্তসাংস্কৃতিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যা আজীবন রয়ে যায়।
মোটকথা, জাপানে থাকার সময়ে জাপানি ভাষার দক্ষতা অনেক সুবিধা দেয়। এটি জাপানি সমাজে ওতপ্রোতভাবে মিশতে সহায়তা করে, পেশাদার সুযোগ-সুবিধাগুলো উন্মুক্ত করে, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়াকে গভীর করে, দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা উন্নত করে এবং আন্তসাংস্কৃতিক সংযোগগুলোকে উৎসাহিত করে। জাপানি ভাষা শেখার জন্য সময় ও প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করে বিদেশিরা জাপানে সম্ভাবনার জগৎকে আনলক করতে পারেন, জাপানে তাঁদের অবস্থানকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে পারেন এবং দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি ও বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারেন। স্বল্পমেয়াদি বেড়ানো বা দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের জন্যই হোক না কেন, বিদেশিরা জাপানি ভাষা শেখার মাধ্যমে যোগাযোগের বাইরেও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে দৈনন্দিন জীবন, কর্মক্ষেত্র কিংবা সামাজিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করার মাধ্যমে জাপানি জীবনকে সার্থক করে তুলতে পারেন।
*লেখক: তৌফীক আহমেদ, কানাজাওয়া সিটি, ইশিকওয়া প্রিফেকচার, জাপান