স্থাপত্য কেবল একটি নির্মাণশৈলী বা কংক্রিটের দেয়াল নয়, এটি মানুষের ধারণা, অনুভূতি এবং সংস্কৃতির এক অভিব্যক্তি। স্থাপত্য একটি শিল্প; যা সময়, স্থান, প্রযুক্তি এবং মানবিক চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে।
একটি ভবন বা কাঠামো শুধু তার শারীরিক আকার ও উপাদানে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি একটি জীবন্ত সংগীতের মতো, যা পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে এবং মানুষের জীবনে এক নতুন দৃষ্টিকোণ নিয়ে আসে।
প্রতিটি স্থাপত্যকর্ম তার নিজস্ব এক ভাষায় কথা বলে—কখনো তা আবেগের, কখনো তা যুক্তির, আবার কখনো এটি এক নতুন ভাবনা বা উদ্ভাবনের প্রতিফলন। আধুনিক স্থাপত্য শুধু নান্দনিক নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায়, যা কেবল আমাদের প্রয়োজনই পূরণ করে না, আমাদের অনুভূতিকে আরও গভীর করে তোলে।
এবারের চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য সম্মেলনে এমনই এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা পাওয়া গেল। গতকাল বুধবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে এ সম্মেলন। সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের একাডেমিক কাউন্সিল কক্ষে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিমুদ্দীন খান।
সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শীর্ষস্থানীয় স্থপতি, শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী এবং উদ্যোক্তারা। অংশগ্রহণকারী গবেষকেরা স্থাপত্যের নানান শাখা যেমন শহুরে পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব নকশা, আধুনিক নির্মাণ কৌশল এবং ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়ে তাদের সৃষ্টিশীল কাজ ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সম্মেলনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের তৈরি স্থাপত্যকর্ম প্রদর্শনী। কেউ তৈরি করেছেন হাসপাতাল, কেউ স্টেডিয়াম, কেউ বহুতল ভবন; কিন্তু সবকিছু স্থান পেয়েছে একই ছাদের নিচে। সবই আসলে আদল, কোনটি পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ নয়। শিক্ষার্থীরা তাঁদের বছরের পর বছর ধরে অর্জিত দক্ষতা এবং চিন্তাভাবনা থেকে নানা ধরনের স্থাপত্য ডিজাইন, মডেল এবং কল্পনাশক্তির মাধ্যমে নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করেন সেখানে। তাঁদের প্রতিটি সৃষ্টিকর্মের পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত সৃজনশীলতা এবং ভবিষ্যতের নগর–পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ এবং আধুনিক স্থাপত্য প্রযুক্তির সমন্বয়। প্রতিটি স্থাপত্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক অনন্য গল্প, ধারণা ও গভীর চিন্তা।
তবে এসব সৃষ্টিকর্ম যতটা না দৃষ্টিনন্দন, সেটি তৈরির পেছনের গল্প ততটা কঠিন। এগুলো তৈরিতে নানা প্রতিকূলতা ও কাঠখড় পোহাতে হয় শিক্ষার্থীদের, কাটাতে হয় নির্ঘুম রাত। চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহীদুল ইসলাম মাহী বলেন, আমরা প্রতি সেমিস্টারে বিভিন্ন রকমের প্রজেক্ট করে থাকি। এই স্থাপত্যকর্ম তৈরি শুধু একটি সৃজনশীল কাজ নয়, এটি একটি দীর্ঘ, কঠিন ও অধ্যবসায়ভিত্তিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি সৃষ্টিকর্মের পেছনে রয়েছে আমাদের প্রচুর সময়, শ্রম, গবেষণা ও বিশ্লেষণ। প্রথমে যখন একটি নকশার ধারণা মাথায় আসে, তখন সেই ধারণা শুধু একটি রূপরেখা হয়; কিন্তু তা বাস্তবায়নে আনতে আমাদের অনেক কাঠামোগত, পরিবেশগত এবং সামাজিক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। পরিকল্পনা, ডিজাইন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে অনেকবার পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়। কখনো কখনো আমাদের পূর্বপরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়, বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এসব ধাপ সম্পন্ন করে একটি প্রজেক্ট শেষ করতে কাটাতে হয় নির্ঘুম কত রাত। ক্লান্তির শেষে যখন একটি প্রকল্প সম্পূর্ণ হয় এবং সেটি বাস্তবে রূপ নেয়, তখন সেই পরিশ্রমের ফলাফল যে কতটা সন্তোষজনক হতে পারে, তা অনুভব করা যায়।
আয়োজকরা মনে করেন, এ ধরনের সম্মেলন স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সম্মেলন আয়োজন কমিটির সভাপতি স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সজল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, 'এই স্থাপত্য সম্মেলন শুধু প্রদর্শনী নয়, এটি একটি শিক্ষার ক্ষেত্র, একটি সৃষ্টি এবং উন্নতির মঞ্চ, যেখানে ভবিষ্যতের স্থপতিরা এক নতুন পৃথিবী নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সম্মেলন শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করে দেয় একটি বিশাল সুযোগ, যেখানে তাঁরা বিশ্বমানের চিন্তা ও নকশার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছেন। এটি একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে তাঁরা তাঁদের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রযুক্তিগত ধারণাকে একত্র করে নতুন সমাধান এবং বিকল্প পথের সন্ধান পাচ্ছে। সম্মেলনে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাঁদের বিভিন্ন সৃষ্টিকর্ম প্রদর্শন করেছেন। তাঁদের কাজের মধ্যে যে সৃজনশীলতা, প্রযুক্তির সংমিশ্রণ এবং মানবিক চিন্তা ফুটে উঠেছে, তা আগামী দিনের শহরগুলোর রূপ এবং স্থাপত্যশিল্পের ভবিষ্যৎকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সহায়ক হবে বলে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করি। বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় আমরা সফলভাবে সম্মেলন সম্পন্ন করতে পেরেছি, তাই তাদের প্রতি রইল অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।