দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রায় ৯৬ থেকে ৯৭ ভাগ প্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্ত। এত বড় শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বা শক্তিশালী কাঠামো হচ্ছে ‘শিক্ষক নিয়োগ’।
এই শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় এক নীরব বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে সম্ভবত বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশের মাধ্যমে। স্কুল বা কলেজ কমিটি কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পর থেকে প্রায় এক লাখের বেশি শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এনটিআরসিএর প্রতিটি নিয়োগ কার্যক্রম অত্যন্ত স্বচ্ছভাবেই কোনো প্রকার ঘুষ বা দুর্নীতি ছাড়াই সম্পন্ন হচ্ছে, যা উচ্চশিক্ষিত লাখো বেকারের অন্যতম আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে, আবার অন্যদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অত্যন্ত যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ সম্ভব হচ্ছে, যা একটি দেশের উচ্চশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য বৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করা যায়।
এখন অনেক তরুণ শিক্ষকতা পেশায় আসছেন। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত এসব মেধাবী তরুণ শিক্ষকতা পেশায় এসে কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
এনটিআরসিএর মাধ্যমে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ ও নিয়োগের জন্য সুপারিশ পাওয়া একজন প্রবেশনারি পর্যায়ের শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে জাতীয় বেতন কাঠামো অনুসারে ৯ম, ১০ম ও ১১তম স্কেলে বেতন শুরু হয়। কলেজপর্যায়ের প্রভাষকেরা ৯ম গ্রেডে, স্কুলপর্যায়ে সহকারী শিক্ষক বিএড ছাড়া ১১তম গ্রেডে ও বিএড থাকলে ১০ম গ্রেডে বেতন শুরু হয়।
অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০সহ মোট ১ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত যুক্ত হয়। তা ছাড়া সরকার কর্তৃক ঘোষিত সর্বশেষ বিশেষ প্রণোদনা ৯ম ও ১০ম গ্রেডের জন্য ৫% হারে অন্যান্য নিচের গ্রেডে যাঁরা আছেন, তাঁদের ১০০০ টাকা দেওয়া হয়। মোট বেতনের ওপর আবার অবসর-সুবিধা ও ভবিষ্যৎ কল্যাণ তহবিলের জন্য ১০% পরিমাণ টাকা কেটে রাখা হয়।
মাসিক নিট বেতন হিসাব করলে একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত কলেজ প্রভাষক ২২ হাজার ৪০০ টাকা ও মাদ্রাসা, কারিগরি ও হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন। উৎসব ভাতা হিসেবে মূল বেতনের ২৫%, দুই ঈদে দুটি উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতাও পেয়ে থাকেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা। অন্যান্য চাকরির মতো প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট সুবিধা পাওয়া যায়। স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক থেকে পর্যায়ক্রমে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক পর্যন্ত হওয়া যায়।
কলেজের প্রভাষকেরা আট বছর পূর্তিতে আনুপাতিক হারে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তী সময় পদোন্নতি পেয়ে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ থাকে।
একজন প্রভাষক বা শিক্ষক ৬০ বছর চাকরি শেষে অবসর গ্রহণ করলে অবসরকালীন ও ভবিষ্যৎ কল্যাণ তহবিল থেকে এককালীন সুবিধা পেয়ে থাকেন। সরকারি অন্যান্য চাকরির মতো কোনো প্রকার পেনশনের ব্যবস্থা নেই।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার বদলির ব্যবস্থা চালু করেনি সরকার। এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা বদলি সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যা শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও যন্ত্রণার। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকেরা বদলির দাবি আদায়ে রাজপথে নেমেছেন, যা এখনো চলমান। কিন্তু কার্যকরী উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, যা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার করেছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ সুপারিশ যতটা সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও যোগদান সম্পন্ন করতে ও এমপিও করাতে। সময়ে সময়ে এসব অভিযোগ বা অনিয়মের খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়, যা নিয়ে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও করেছেন। নিয়োগ সুপারিশের মতোই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যোগদান প্রক্রিয়া ও এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ ও ঝামেলামুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে তরুণ মেধাবী নিবন্ধিত শিক্ষকদের ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে।
যত দূর পারা যায় নিয়োগ সুপারিশ থেকে এমপিওভুক্তি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব তরুণ শিক্ষকের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা সময়ের যৌক্তিক দাবি হয়ে উঠেছে।