পিএইচডির জন্য বাইরের মাটিতে প্রথম দিনগুলো : প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ

বিদেশ—কত মানুষের কাছে এক অধরা স্বপ্নের নাম। মনে হয় দেশের সীমারেখা পার হলে বুঝি সাক্ষাৎ জাদুকরি কোনো দুনিয়ার দরজা চিচিং ফাঁক করে খুলে যাবে। আমাদের দেশের হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত মানুষের জন্য মুক্তির নাম বিদেশ। নিজের না–হওয়া সত্ত্বেও প্রবাসী ট্যাগে কতজন সন্তুষ্ট চিত্তে দেশ ছেড়ে প্রতিবছর অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমান। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে বিদেশের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু সত্যিই কি আলিবাবার কোনো খাজানা লুকিয়ে আছে এই ভিনদেশি মাটিতে? প্রশ্নের উত্তরটা আসলে আপেক্ষিক। কারও চোখে থাকে অনেক দিনের স্বপ্নপূরণের নেশা, অনেকের জন্য এ প্রথম দিনগুলোই কিছু সাদামাটা ব্যাপার না–জানার জন্য দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ মানুষই অচেনা জায়গায় এসে কোথা থেকে কাজ গোছানো শুরু করতে হবে, বুঝে উঠতে পারেন না। চলুন জেনে আসা যাক এমন কিছু প্রস্তুতি ও পদক্ষেপের কথা, যা বাইরের দেশে আপনাকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজ ফিডে উড়ে আসা প্রবাসীদের ছবির চাকচিক্য আসলে সবটুকু সত্য বর্ণনা করে না। একজন মানুষ যখন বিমানবন্দরের গেট পার হয়, ওই মুহূর্তে খুব অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে থাকে। চোখের দৃষ্টিসীমা থেকে যখন পরিবারের সদস্যরা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যায়, সেই সময় প্রথমবার মনে হয়, এই যে ঘরের বাইরে যে পা বাড়িয়েছি, সেই ঘরে আদৌ কি ফেরত যেতে পারব? কানের মধ্যে এক নিরবচ্ছিন্ন ঝিঝি শব্দ, বুকের কোথাও প্রচণ্ড তীব্র কষ্ট আর অশ্রুসজল চোখে নিজের ভেতর যুদ্ধ চলতে থাকে, নিজের নতুন বাস্তবতাকে আপন করে নেওয়ার অনন্ত সংগ্রাম। বিমান যখন আকাশের প্রান্তর ছুঁয়ে যায়, আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে সঙ্গে থাকা ফোনের নেটওয়ার্ক। বিমানের জানালা দিয়ে প্রথমবার আবিষ্কার করবেন পাখির চোখে দেশের সৌন্দর্য। বুকের চিনচিনে ব্যথা যেন তীব্র হয়ে ওঠে, এ যেন ‘নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।’ কিন্তু তখন ফেরত আসার পথটা বন্ধ হয়ে যায়। তখনই মনে ভেসে ওঠে এত দিনের এত সাধনার কথা, এই দিনের জন্যই তো কত তপস্যা, কত পরিশ্রম করে একটা বৃত্তি পাওয়া। সাহস সঞ্চয় করে শুরু করুন পথচলা, বিদেশের মধ্যে নিজেকে খুঁজে ফেরা। এই মানসিক টানাপোড়েন সামলে নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্ত মনোবল তৈরি করে তবেই দেশ ছাড়ার কথা ভাবা উচিত।

বিদেশের মাটিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আবাসন ও বাঙালি খাদ্য। কেউ যখন বাইরে আসার জন্য প্রস্তুত হতে চান, তাঁর অবশ্যই ওখানে বসবাসরত বাঙালিদের খুঁজে বের করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে। সত্যি বলতে, বিদেশের পরিবেশে অভিযোজনের শুরুর দিনগুলোতে পরিচিত বাঙালি ভাইবোনই আপনার রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করবেন। আবাসনের ব্যবস্থা অবশ্যই আগেই করে আসতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, ভিনদেশে আসার সময় অবশ্যই ওই দেশের কিছু অতিরিক্ত অর্থ সঙ্গে বহন করা জরুরি। আমাদের দেশের মতোই এখানেও যেকোনো বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে আগাম কিছু টাকা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ড মানি দিতে হয়। দেশের তুলনায় বিদেশের মুদ্রার মূল্যমান বেশি হওয়ায় এই অর্থ কিন্তু পরিমাণে কম হয় না। সে ক্ষেত্রে একটা ভালো পরিমাণ অর্থ এর পেছনেই চলে যায়। সঙ্গে নতুন দেশে আসামাত্র কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আপনার প্রাথমিক দিনগুলোতেই কিনতে হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আপনার দেশ থেকে নিয়ে আসা অতিরিক্ত অর্থ কাজে আসবে বেশ। এবার আসি বাঙালি খাদ্যে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’—কথাটি কেন বলা হয়, তা একমাত্র বিদেশে এলেই বোঝা সম্ভব। বিদেশের মাটিতে প্রকৃত বাংলাদেশি ‘ভাত’ খুঁজে পাওয়া সত্যিই এক যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। একে তো আপনি নতুন, রাস্তা–ঘাট–দোকান চিনতে একটু হলেও সময় লাগবে। অনেকেই এখানে এসে কয়েক সপ্তাহ ভাতের খোঁজ পাননি। প্রথম কয়েক দিন কোনোভাবে কেটে গেলেও একসময় বাঙালি পেট ভাতের অভাবে ভুগবেই। আর শুরুর দিকের দিনগুলোতে একটা বড় ভরসাস্থল হয়ে যায় স্থানীয় দেশি ভাইবোনেরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন নতুন বাঙালির প্রথমদিকের তিন–চার দিনের খাওয়াদাওয়া বাঙালিরা আপ্যায়ন করেন। কিন্তু সেই জন্য আগে তাঁদের জানতে তো হবে যে নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে তাঁদের মধ্যে। তাই আসার আগে অবশ্যই কাউকে খুঁজে বের করুন, যিনি আপনার এই যাত্রার শুরুর দিনগুলোতে সারথির কাজ করবে। তবে হ্যাঁ, দিন শেষে কিন্তু আপনাকে স্বাবলম্বী হতেই হবে। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব নিজের খাওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিন। চেষ্টা করুন যে দেশে গিয়েছেন, সেখানকার খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হতে। সে ক্ষেত্রে সময় হয়তো লাগবে, কিন্তু হাজার কাজের মধ্যে খাদ্যাভাবে ভুগবেন না। প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন মুদিসামগ্রীর দোকানগুলো যত দ্রুত সম্ভব চিনে নিন।

নিজের পাসপোর্ট ও ভিসার কপি সব সময় সঙ্গে রাখবেন ভিনদেশের প্রথম দিনগুলোয়। যেকোনো দেশে নেমে আপনার প্রথম কাজ ওই দেশের সিম নেওয়া। সাধারণত বিমানবন্দরের মধ্যেই সিম কেনা সম্ভব। দেশে থাকাকালীন সম্ভব হলে একটু খোঁজ নিয়ে যাবেন কোনো কোম্পানির সিম ছাত্রবান্ধব খরচের প্যাকেজ অফার করে। আপনি যদি পূর্ণবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী হন, অর্থাৎ আপনার টিউশন ফি এবং লিভিং কস্ট আপনার বৃত্তির টাকার মাধ্যমে বহন করা গেলে, আপনার বিদেশে গিয়েই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা লাগবে। বাইরের দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাও খুব সহজ। শুধু পছন্দসই ব্যাংকে নিজের পাসপোর্ট, ভিসা ও ভর্তির কাগজপত্র নিয়ে যাবেন। ব্যাংকের কর্মকর্তারাই আপনাকে অ্যাকাউন্ট খোলার পথ বাতলে দেবেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যাতায়াতের ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের বাইরের দেশগুলোয় যোগাযোগ সাধারণত গণপরিবহন–নির্ভর। অন্তত শুরুর দিনগুলোয় আপনার পাবলিক বাস বা ট্রেনের ভরসা করতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবহনে ওঠার জন্য কার্ড থাকে এবং আপনাকে তাতে টাকা ভরতে হবে। যেকোনো নতুন দেশে গিয়েই চেষ্টা করুন যাতায়াতব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে, আর এমন কোনো কার্ড থাকলে কিনে নিতে। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য যাতায়াত ভাড়া মওকুফের ব্যবস্থা থাকে। যদি এমন হয়, তাহলে সে সুবিধা নিতে কার্পণ্য করবেন না। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিবন্ধন করে ফেলুন।

লেখক

যখন সবকিছু গুছিয়ে শেষ, তখন শুরু হবে আপনার আসল যাত্রা—পিএইচডি–যাত্রা। বাইরের পড়াশোনা ও কারিকুলাম অবশ্যই আমাদের চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু এতে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। আপনার মাথায় রাখতে হবে আপনার ভর্তিপ্রক্রিয়া চলাকালীন আপনার মেধা ও যোগ্যতার যাচাই করা হয়েছে। আপনি এই ভিন্নতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উপযোগী বলেই বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে সুযোগ করে দিয়েছে। নতুন জায়গায়, নতুন সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে একটু সময় লাগবে বৈকি। কিন্তু এতে হতাশ হলে চলবে না। আপনার মেন্টর বা সুপারভাইজার যদি নির্দিষ্ট কেউ হন, তাঁর সঙ্গে নিজের সমস্যাগুলো ভাগাভাগি করুন। এখানে বেশির ভাগ মানুষ অনেক সাহায্যপরায়ণ। কাজেই আপনার যেকোনো সমস্যা মন খুলে জিজ্ঞেস করুন। কথা বলার মাধ্যমে হয়তো সমাধান খুঁজে পাবেন খুব সহজে। সব সময় মাথায় রাখবেন, এ সময়টুকু খুব সাময়িক। আস্তে আস্তে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শুরু করলে পড়াশোনাও অতটা কঠিন বলে মনে হবে না।

সব সময় মনে করবেন, আপনি অত্যন্ত সম্মানজনক একটি ডিগ্রি অর্জন করতে ঘর–পরিবার ছেড়ে দেশ থেকে সাতসমুদ্র তেরো নদী পারে কোনো এক দূরদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। দিন শেষে আপনার এই শিক্ষা শুধু আপনাকেই যে জ্ঞানবান করবে তা–ই নয়, এই অভিজ্ঞতা আপনাকে মানুষ হিসেবে উন্নততর করে তুলবে। অনেক চড়াই–উতরাই হয়তো থাকবে পথে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনার গবেষণালব্ধ ফলাফল হতে পারে পুরো মানবজাতির কল্যাণের পাথেয়। তাই সংশয় নয়, শুভ চিন্তা দিয়ে শুরু হোক আপনার পিএইচডি–যাত্রা।

*লেখক: তাসমিয়াহ সাদ সুতপা, সহকারী অধ্যাপক (অধ্যয়ন ছুটি), পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, কুইন্স ল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, অস্ট্রেলিয়া