জার্মানিতে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত কর্মীর অভাব এবং বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই এ আশঙ্কা। পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাব এবং বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ২০৩৫ সালের মধ্যে জার্মানিতে ৭০ লাখ দক্ষ কর্মী ও শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে দেশটির শ্রমবাজারে ভারতের শিক্ষার্থীদের প্রবেশের বা অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সামনে এসেছে।
জার্মানিতে এ মুহূর্তে প্রায় ৭ লাখ চাকরির সুযোগ থাকলেও তা পূরণ হচ্ছে না। দেশটিতে বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৮০-এর দশকে এটা ছিল ২ শতাংশ। এ সমস্যার সমাধান না হলে জার্মানির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হ্যাবেক জানিয়েছেন, এ সমস্যা সমাধানে অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে দেশটির শ্রমবাজারে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সুযোগ প্রদান
জার্মানির পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুসারে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই মুহূর্তে প্রায় ৪৩ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিসের মুখপাত্র মাইকেল ফ্ল্যাকের মতে, দেশটির মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ শতাংশ। তিনি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক ছাত্ররা প্রায়ই ‘তথাকথিত যোগ্য অভিবাসী’ হয়। কারণ, তাঁরা ইতিমধ্যেই জার্মানিতে বাস করার পাশাপাশি জার্মান ভাষা শিখে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একই সময়ে আমরা জানি যে জার্মান ভাষা শেখা, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পথ খুঁজে বের করা এবং শ্রমবাজারে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশ বিশেষ চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করবে।’
রেজেনসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসংস্থান গবেষণা বিশেষজ্ঞ এনজো ওয়েবার বলেন, জার্মানির দক্ষ কর্মীদের জন্য বিদেশেও কর্মী খোঁজ করা উচিত। কারণ, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে দেশে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত কর্মী নেই। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সুযোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র শুধু দক্ষ ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করছে ব্যাপারটি এমন নয় বরং ভবিষ্যতে কাজ করার জন্য আরও বেশি লোককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
*পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ কেমন
জার্মানির সাম্প্রতিক ‘স্কিলড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট’ বা দক্ষ অভিবাসন আইনে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি দেবে। এ সময় আগের সময়সীমার দ্বিগুণ।
জার্মানির ড্রেসডেন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পিএইচডি করছেন ভারতীয় শিক্ষার্থী সুরিয়ানশ। ৩৫ বছরের এই শিক্ষার্থী বলেছেন, নতুন এ আইন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করা সহজ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আপনার যদি সঠিক দক্ষতা থাকে এবং ভালো বেতন পান তবে এ দেশে ভালো জীবন কাটাবেন। এমনকি স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগও পেতে পারেন।’ সেমিকন্ডাক্টর এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ আছে বলে জানিয়ে সুরিয়ানশ বলেন, তিনি ও তাঁর বন্ধুরা তাঁদের পড়াশোনা শেষ করার পর দ্রুত চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর ল্যাবে অনেকে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে এনজো ওয়েবারের মতে, নতুন অভিবাসন আইন যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিলেও জার্মান শিক্ষাব্যবস্থার জটিলতার কারণে এখনো বেশ কিছু সংকট আসলে রয়েই গেছে। তিনি মনে করেন, ডিজিটালাইজেশন এবং শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ব্যবহারিক জিনিসগুলোর সমন্বয়ের ওপরই এ আইনের সার্থকতা নির্ভর করে।
*আইটি ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা শিল্পের উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে
মাইকেল ফ্ল্যাক জানিয়েছেন, দক্ষ কর্মীর ঘাটতি শুধু কেয়ার গিভার (যত্ন) এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতেই নয় তথ্যপ্রযুক্তি এবং প্রকৌশলসংক্রান্ত পেশাগুলোতেও বিশেষভাবে আছে। জার্মানিতে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা আইটি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে খুব বেশি পরিমাণে ভর্তি হন। দক্ষ কর্মীর অভাব মোকাবিলার জন্য তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দাবিদার।
প্রকৌশল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জার্মানি ঐতিহ্যগতভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বাজার। ফ্ল্যাক বলছেন, জার্মানিতে আইটি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অধ্যয়নরত ভারতীয় শিক্ষার্থীরা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরা এ খাতের চাকরিগুলো পূরণ করতে সহায়তা করতে পারেন। জার্মানি ইতিমধ্যেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শক্তিশালী হওয়ায় এ খাতে অনেক ভারতীয় শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্তি দেশটিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে সাহায্য করতে পারে।
২৬ বছর বয়সী ভারতীয় শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রহমান খান মেকাট্রনিকস এবং রোবোটিকস বিষয়ে হ্যানোভারের লিবনিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তিনি বলেছেন, জার্মানিতে অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় প্রযুক্তি এবং প্রোগ্রামিং কাজের জন্য একটি বড় চাহিদা রয়েছে।
এনজো ওয়েবার বলেছেন, জার্মানির ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের সত্যিই দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রযুক্তির আধুনিকায়নের জন্য যন্ত্রপাতি এবং শক্তির মতো খাতে চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনকে দিন। জার্মানিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে অন্য দেশ থেকে প্রতিভাবানদের আনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
*কয়েকটি নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে জার্মানিকে
২৪ বছর বয়সী রিয়া জোসেফ ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালার। ড্রেসডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে ২০২৩ সালে জার্মানিতে চলে যান। তিনি মনে করেন, গবেষণা সহকারী থেকে পোস্টডক পর্যন্ত জার্মানিতে একাডেমিক যাত্রা ‘ভবিষ্যতে উন্নতি লাভের জন্য সম্ভাবনাপূর্ণ’। কিন্তু এখনো অনেক কিছুই করার আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিয়োগকর্তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করতে আরও সহায়তা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জার্মানিতে পড়াশোনা করার পর চাকরি খোঁজার জন্যও স্পষ্ট নিয়ম প্রয়োজন।
এনজো ওয়েবার বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং কর্মীদের জন্য এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়গুলো পরিষ্কার এবং সহজ করতে কানাডার মতো দেশকে অনুসরণ করতে পারে জার্মানি। তিনি মনে করেন, জার্মানির অভিবাসন আইনকে প্রতিযোগিতামূলক এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার পাশাপাশি অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে। বিভিন্ন ভিসার বিকল্প প্রদান করতে হবে এবং মানুষকে আরও ভালোভাবে জার্মানিতে মানিয়ে হতে সহায়তা করতে হবে।