আলোচনার কেন্দ্রে নতুন শিক্ষাক্রম 

বিদায়ী বছরে শিক্ষকদের আন্দোলনসহ শিক্ষাক্ষেত্রে নানা বিষয় থাকলেও বেশি আলোচনা নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে।

আগের শিক্ষাক্রমের (২০১২ সালের) প্রায় ১০ বছর পর বিদায়ী শিক্ষাবর্ষের শুরুতে তিনটি শ্রেণিতে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। কিন্তু রূপান্তরিত এই শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণয়ন করা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই শিক্ষাবর্ষ শুরুর এক মাসের বেশি সময় পর আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এখন বছর শেষ হতে চললেও নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলছেই।

এমন অবস্থায় বড় পরিবর্তন নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। দীর্ঘকাল ধরে চলা নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন উঠে যাচ্ছে ১ জানুয়ারি থেকে। এখন দশম শ্রেণি পর্যন্ত আগের মতো বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে আলাদা বিভাগ থাকবে না। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমটি ভালো এবং অনেক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়ে শুরু করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নটি ঠিকমতো না হলে এটি হয়তো শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলবে।
মনজুর আহমদ, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় 

বিদায়ী বছরে শিক্ষকদের আন্দোলনসহ শিক্ষাক্ষেত্রে নানা বিষয় থাকলেও বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল নতুন এই শিক্ষাক্রম; যার রেশ চলবে আরও অনেক দিন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হচ্ছে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা।

চলতি বছরে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হয় নতুন শিক্ষাক্রম। এখন ১ জানুয়ারি থেকে নতুন করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে (উচ্চমাধ্যমিক) বাস্তবায়ন হবে নতুন শিক্ষাক্রম।

নতুন শিক্ষাক্রমে শেখানোর ধরন বদলে গেছে, প্রথাগত পরীক্ষা উঠে গেছে ও যাচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন ধরনের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বিষয়ে কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে, মানে পরীক্ষার ভিত্তিতে, তবে আগের মতো কোনো পরীক্ষা হবে না। এখন যেমন নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষা হয় এখন। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি বোর্ডের অধীনেই আলাদা পরীক্ষা হবে। তারপর এই দুই পরীক্ষার ফলাফল সমন্বয় করে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বই পড়তে হবে। উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ বিভাজন হবে। পরীক্ষার ফল আগের মতো জিপিএর ভিত্তিতে হবে না। নতুন পদ্ধতির মূল্যায়নে তিনটি চিহ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান নির্ণয় করা হচ্ছে। যেমন ত্রিভুজ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয় শিক্ষার্থী ‘দক্ষ’। বৃত্ত দিয়ে বোঝানো হয় ‘অগ্রগামী বা মাঝারি’ এবং চতুর্ভুজ দিয়ে বোঝানো হয় পারদর্শিতার ‘প্রারম্ভিক স্তর’।

শিক্ষাক্রমে যেভাবে হাতে-কলমে শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, তাতে একেকটি ক্লাসে এখনকার মতো বিপুল শিক্ষার্থী নিয়ে সঠিকভাবে শেখানো কঠিন। এ ছাড়া মূল্যায়নের বিষয়টি আরও সহজ করা দরকার বলেও মনে করেন বিদ্যালয় প্রধানদের কেউ কেউ।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, নতুন শিক্ষাক্রমটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারলে এটি ভালো হবে। কারণ, এতে হাতে–কলমে শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ফলে যে শিক্ষা অর্জিত হচ্ছে, তা বাস্তব জীবনে বেশি কাজে দেবে। তবে কেউ কেউ আবার নতুন শিক্ষাক্রমের বিপক্ষেও বলছেন। অভিভাবকদের একাংশ মনে করেন, পুরোনো শিক্ষাক্রমের মতো পরীক্ষা থাকা দরকার, না হলে শিক্ষার্থীরা ‘পড়বে না’।

তবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রস্তুতির ওপর বেশি জোর দেওয়ার পরামর্শ এসেছে বিভিন্ন পর্যায় থেকেই। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়িয়ে তাঁদের নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে যোগ্য করে তোলা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানোর কথা বলছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই। কারণ, এই শিক্ষাক্রমে যেভাবে হাতে-কলমে শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, তাতে একেকটি ক্লাসে এখনকার মতো বিপুল শিক্ষার্থী নিয়ে সঠিকভাবে শেখানো কঠিন। এ ছাড়া মূল্যায়নের বিষয়টি আরও সহজ করা দরকার বলেও মনে করেন বিদ্যালয় প্রধানদের কেউ কেউ। সব মিলিয়ে এই শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি ও পরিবেশের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে সচেতন করে তাঁদের আস্থায় আনতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সরকারি বিনিয়োগ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী বছরের জন্য তাঁরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রথমবার হওয়ায় অনেকেরই হয়তো মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবে বলে তাঁরা মনে করেন।

চলতি বছরে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হয় নতুন শিক্ষাক্রম। এখন ১ জানুয়ারি থেকে নতুন করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে (উচ্চমাধ্যমিক) বাস্তবায়ন হবে নতুন শিক্ষাক্রম।

নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসানও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবায়নের ওপরই শিক্ষাক্রমের সফলতা নির্ভর করবে। এই শিক্ষাক্রম নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, সেটিও ইতিবাচক। আলোচনা গঠনমূলক হলে সেখান থেকে যে ‘ফিডব্যাক’ পাওয়া যাবে, সেটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সহজ হবে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

শিক্ষকদের আন্দোলন

বিদায়ী বছরে দাবি আদায়ে শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়েও আলোচনা কম ছিল না। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে গত ১১ জুলাই শুরু করে ২৩ দিন রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বেসরকারি শিক্ষকেরা। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু হয়নি।

এদিকে আন্তক্যাডার-বৈষম্য নিরসন ও সুপারনিউমারারি পদ (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত পদ) সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে গত অক্টোবরে কর্মবিরতিতে নামেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। পরে আন্দোলনকারী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলন স্থগিত করেন। এখন পর্যন্ত মূল দাবি পূরণ হয়নি। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা আশা করছেন, হয়তো দ্রুত সময়ের মধ্যে মূল দাবির একটি পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে।

তবে লটারির মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ভর্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেছে। বিদায়ী বছরের মতো আসন্ন শিক্ষাবর্ষেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিদ্যালয়গুলোতে লটারিতে শিক্ষার্থী ভর্তির বাছাই হয়েছে। লটারিতে ভর্তির ফলে একদিকে ভর্তির পরীক্ষা নিয়ে ‘মাতামাতি’ বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে ভালো বিদ্যালয়ে কেবল ‘ভালো শিক্ষার্থীরাই’ ভর্তি হওয়ার সুযোগ কমেছে।

শিক্ষা মূলত দুটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। একটি হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আরেকটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী দীপু মনি এবং উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু মনোনয়ন পাননি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিদায়ী বছরটি কেমন গেল এবং আগামী বছরের প্রত্যাশার বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী বছরটি খুব যে ভালো গেছে, সেটি বলা যায় না। করোনা মহামারির প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। নতুন শিক্ষাক্রমটি ভালো এবং অনেক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়ে শুরু করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নটি ঠিকমতো না হলে এটি হয়তো শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলবে। এ ছাড়া শিক্ষার মান, বৈষম্য এবং যথেষ্ট অর্থায়নের সমস্যা তো আছেই। তাঁর আশা, কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য শিক্ষা নিয়ে যে চিন্তাভাবনা, তা সফল করার চেষ্টা করা হবে।