বর্তমানে গরমের তীব্রতা অসহনীয় করে তুলেছে মানুষের জীবন। বিশেষ করে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের জন্য এই প্রতিকূল অবস্থা আশঙ্কাজনক। অত্যধিক ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় তরল বেরিয়ে যাওয়ার কারণে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়। আর এ ঝুঁকির মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে এই কম বয়সী শিক্ষার্থীরাই। তাই উষ্ণ আবহাওয়ায় প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপের। উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। তাই চলুন, গরমের তীব্রতা থেকে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
* দিনের তীব্র গরমের সময় সূর্যালোক এড়িয়ে চলা
সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অতিবেগুনি রশ্মি সবচেয়ে বেশি তীব্র থাকে। আর দিনের এই সময়েই শিক্ষার্থীরা সাধারণত ক্লাস এবং স্কুল-পরবর্তী খেলাধুলার জন্য ঘরের বাইরে থাকে। তাই এই সময়ে শিক্ষার্থীদের বিচরণের জায়গাগুলোতে সর্বাত্মকভাবে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গাছগাছালিতে ঘেরা প্রাকৃতিক ছায়াশোভিত স্থান সর্বোত্তম। তবে এর পাশাপাশি ছাউনির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। খেলাধুলার সময় শিক্ষার্থীরা যেন উন্মুক্ত জায়গায় চলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সূর্যালোকের সংস্পর্শ এড়ানোর জন্য আরেকটি উত্তম উপায় হলো শিক্ষার্থীদের ইনডোর গেমের প্রতি আকৃষ্ট করা। এতে তাদের বিনোদনও হবে, একই সঙ্গে তাদের শরীরও ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচবে। এটি ছুটির দিনে ঘরের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
* গরমে আরামদায়ক পোশাক
শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়াসহ বিভিন্ন উপলক্ষে ঘরের বাইরে থাকার সময়ে হালকা বুনন, হালকা ও এক রঙের কাপড় পড়তে হবে। হাতাকাটা শার্ট বা গেঞ্জি এবং হাফপ্যান্ট বা শর্টস এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু কাপড়ের উপাদান এবং শিক্ষার্থীদের শরীরের কতটা অংশ উন্মুক্ত থাকছে, সেদিকে কড়া নজর দেওয়া আবশ্যক। এ ছাড়া হাতাকাটা বা শর্টসের ক্ষেত্রে কাপড় যদি অনেক মোটা বা ভারী হয়, তাহলে তা আরও গরম করে তুলতে পারে। রোদের সংস্পর্শে উন্মুক্ত হাত-পায়ের চামড়া পুড়ে যেতে পারে। তাই শরীর যতটা ঢেকে রাখা যায়, ততই ভালো। অর্থাৎ লম্বা হাতা ও লম্বা প্যান্ট বেছে নেওয়া উত্তম। আর কাপড় ঢিলেঢালা ফিটিং ও হালকা রঙের হলে তা বাতাস চলাচলের জন্য উপযোগী হয়।
* সানস্ক্রিন ব্যবহার
সকালে স্কুলে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে শিশুশিক্ষার্থীদের শরীরের উন্মুক্ত অংশে সানস্ক্রিন লাগিয়ে দিতে হবে। কিশোর বয়সীদের ক্ষেত্রে মা–বাবাদের তাঁদের সন্তানকে সানস্ক্রিন ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ছোট থেকে অভ্যাস করানো হলে কিশোর বয়সীরা নিজেরাই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে শিখে যাবে। এ অভ্যাস কার্যকর করার জন্য প্রতিবার ঘর্মাক্ত হওয়ার দুই ঘণ্টা পরপর সানস্ক্রিন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া স্কুলের খেলাধুলার পর বাচ্চাদের সানস্ক্রিন প্রয়োগ করতে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। একটি গলফ বলের মাপের সমান বা প্রায় ২৮ গ্রাম সানস্ক্রিন পুরো শরীরে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শরীরের যে অংশগুলো সাধারণত এড়িয়ে যায়, সেগুলোতে বেশি নজর দেওয়া উচিত। যেমন কানের পেছনে, ঘাড়ে, হাত ও পায়ের উল্টো পিঠের অংশগুলো।
* ছাতা ব্যবহার
স্কুলে যাওয়া–আসা নিয়ে প্রতিদিনই বাচ্চাদের একটি উল্লেখযোগ্য সময় রোদের আলোয় কাটাতে হয়। সূর্যালোক প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরিধান ছাড়াও এ সময়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ছাতা ব্যবহার করা। খুব নান্দনিক ও রংচঙা নয়, এ ক্ষেত্রে খেয়াল দিতে হবে ছাতাটি রোদ থেকে কতটা ছায়া দিতে পারছে, তার ওপর। মুষলধারে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে যেভাবে ছাতা ব্যবহার করা হয়, এ ক্ষেত্রেও একই কাজ করা উচিত। আর ছোট শিক্ষার্থীদের এ অভ্যাস তৈরিতে আদর্শ হতে পারে পিতামাতা ও পরিবারের অন্য প্রাপ্তবয়স্করা।
* ঘরকে ঠান্ডা রাখা
গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে ঘরে থাকতে হলে সেই ঘরকেও রাখতে হবে তাপমুক্ত। কেননা, বাইরে থেকে রোদের আলো ঘরে ঢুকে অথবা ঘরের দেয়াল রোদ শুষে নিয়ে ঘরকে উত্তপ্ত করে তোলে। এ অবস্থা থেকে শতভাগ মুক্তি না মিললেও সম্ভাব্য কার্যকর উপায়গুলো অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন হলুদ ও হ্যালোজেন বাল্বগুলো প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। তাই এগুলোর বদলে ব্যবহার করতে হবে এলইডি লাইট, যা ঘর ঠান্ডাও রাখে, আবার বৈদ্যুতিক খরচের দিক থেকেও বেশ সাশ্রয়ী।
দিনের উত্তপ্ত সময়গুলোতে জানালার পর্দা টেনে দিতে হবে। জানালা বন্ধ রাখা হলে ঘরের ভেতর সূর্যালোকের ঢুকতে আরও একধাপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। ঠিক সন্ধ্যার দিকে পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিলে বাইরের ঠান্ডা বাতাস ভেতরে প্রবেশ করবে। এতে দিনের বেলা বাইরের গরম বাতাস ভেতরে আসবে না। রাতভর ঘরের ভেতর জমা হওয়া ঠান্ডা বাতাস দিনের বেলা বাইরে যেতে পারবে না।
* বেশি বেশি পানি পান
পানিশূন্যতার মতো গরম আবহাওয়ার ফলে সৃষ্ট নানা ধরনের রোগবালাই থেকে বাঁচতে পানি পানের কোনো বিকল্প নেই। স্কুল বা বাড়ি যেখানেই থাকুক না কেন, বাচ্চাদের পড়াশোনা ও খেলাধুলার সময় নির্দিষ্ট সময় পরপর পানি বিরতি দিতে হবে। এমনকি তারা তৃষ্ণার্ত না থাকলেও চালিয়ে যেতে হবে এই কার্যক্রম। বেশি বেশি পানি পান শুধু পানিশূন্যতাই প্রতিরোধ করে না, বাচ্চাদের দাঁতের ক্ষয়ের ঝুঁকিও কমাতে পারে।
আমেরিকার জাতীয় একাডেমি মেডিসিন ইনস্টিটিউট অনুসারে, ৯ থেকে ১৩ বছরের ছেলেদের জন্য প্রতিদিন পানি পান করতে হবে ৮ কাপ। আর একই বয়সের মেয়েদের প্রতিদিন ৭ কাপ পানি পান করা উচিত। ১৪ থেকে ১৮ বছরের ছেলেদের বেলায় এই পরিমাণ প্রায় ১১ কাপ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রায় ৮ কাপ।
* পানিশূন্যতা রোধকারী ফল ও সবজি খাওয়া
গ্রীষ্মের খরতাপ থেকে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সেরা উপায় হচ্ছে সর্বাধিক পানিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। এ ক্ষেত্রে গ্রীষ্মকালীন ফল তরমুজ একটি উৎকৃষ্ট খাবার। কেননা, এতে রয়েছে ৯১ শতাংশ পানি। এ ছাড়া অন্য ফল-ফলাদির মধ্যে রয়েছে আঙুর, আপেল, চেরি, কমলা ও আনারস। এগুলো সরাসরি অথবা জুস বানিয়ে কিংবা সালাদ করেও খাওয়া যায়। তরকারির মধ্যে রয়েছে পালংশাক, টমেটো, শসা, মুলা, ফুলকপি, গাঁজর, পুদিনাপাতা, পেঁয়াজকলি, ঢ্যাঁড়স ও লাউ। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এই ফল এবং শাকসবজি থাকা মানে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন পাওয়া। এই পুষ্টি উপাদান পানিশূন্যতা রোধের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও সহায়তা করে।
* প্রতিদিন গোসল করা
স্কুল বা যেকোনো উপলক্ষে বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পরপরই গোসল করা একটি স্বাস্থ্যবিধি। এমনকি এটি একাধিকবার দীর্ঘ সময়ের জন্য বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা, যখন গোসলের পানি বাচ্চার ত্বক ভিজিয়ে দেয়, তখন শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর কার্যকলাপের জন্য নির্ধারিত তাপমাত্রা বজায় থাকে। এই পরিমিত তাপমাত্রাতেই রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে শরীরকে সতেজ করে তোলে। তবে গোসলের সময় আরামদায়ক তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করা উচিত। খুব গরম বা খুব ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা যাবে না। এভাবে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত গোসলে অভ্যস্ত হলে উত্তাপজনিত অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
* মাত্রাতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে চলা
রাজধানী ঢাকা অত্যধিক ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর। ঢাকার বাতাসে উত্তাপের আশঙ্কাজনক পরিমাণের পেছনে এ জনসংখ্যাও একটি কারণ। তাই রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় পারতপক্ষে সর্বদা অতিরিক্ত ভিড়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। যেকোনো ভিড়ে প্রত্যেক মানুষের দেহের তাপ একত্র হয়ে সেখানকার পরিবেশকে অস্বস্তিকর করে তোলে। বিষয়টি এমনকি এক জায়গায় একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী থাকাটাও ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে ক্লাসরুমের, স্কুল ভ্যান বা গাড়ির প্রশস্ততা বিবেচনায় আনা আবশ্যক। এ ছাড়া যানজটের মধ্যে ইঞ্জিন চালুরত গাড়িগুলো থেকেও উত্তাপের সৃষ্টি হয়। আর এ রকম পরিবেশের মধ্য দিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে হেঁটে যাওয়াটাও অস্বাস্থ্যকর।
* পোকামাকড় অপসারণ করা
তাপ যত বাড়তে থাকে, তার সঙ্গে বাড়তে থাকে পোকামাকড়ের উৎপাত। এ সময় বিশেষ করে মশার উপদ্রব থেকে দূরে থাকতে হবে। জানালার কর্নারে, ঝোপঝাড়ে এবং বাগানে ফুলের টবে জমে থাকা পানি নিয়মিত অপসারণ করা জরুরি। স্কুল ও বাসাবাড়িতে বাচ্চাদের খেলাধুলার জায়গাগুলোতে পোকামাকড়ের বাসাগুলো খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে হবে। সতর্কতা আরও বাড়াতে বাচ্চাদের নিয়মিত মশা বা পোকামাকড় নিরোধক ব্যবহারের শিক্ষা দিতে হবে।
গরমের তীব্রতায় স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এই উপায়গুলো প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। ঘরের বাইরে চলাচলের সময় ছায়া খোঁজা আর ঘরের ভেতরের পরিবেশ ঠান্ডা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা আবশ্যক। মোটকথা, সূর্যালোকের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে যেকোনো মূল্যে শরীরটাকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। পানিশূন্যতা পূরণের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো বেশি বেশি পানি পান করা। অন্যদিকে শরীরকে রোগ প্রতিরোধক্ষম রাখবে অধিক পরিমাণে পানিসমৃদ্ধ ফল ও সবজি। অতঃপর ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি নিয়মিত গোসল করা শিক্ষার্থীদের ধাবিত করতে পারে একটি স্বাস্থ্যকর জীবন ধারণের দিকে।