যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসতে চান, এমন অনেকেরই জিজ্ঞাসা আবেদনের জন্য সর্বোত্তম সময় কোনটি? আজকের পর্বে আমরা সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করব। তবে শুরুতেই বলে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসার ক্ষেত্রে মোটামুটি একটা দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে, জিআরই ও আইইএলটিসের জন্য প্রস্তুতি নিতে শিক্ষার্থীদের একটা উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করতে হয়। তবে উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানা থাকলে প্রস্তুতি নিতে সহজ হয়। সাধারণত কেউ ছয় মাস থেকে এক বছর পরিকল্পিতভাবে সময় দিলে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য আসা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণত তিনটা সেমিস্টার থাকে। এগুলো হলো—ফল সেমিস্টার (আগস্ট–ডিসেম্বর), স্প্রিং সেমিস্টার (জানুয়ারি–মে) ও সামার সেমিস্টার (মে–জুন থেকে জুলাই–আগস্ট)। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে/সব প্রোগ্রামে তিন সেমিস্টারেই ক্লাস হয় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বা কিছু কিছু প্রোগ্রামে কেবল দুটি সেমিস্টারে (ফল ও স্প্রিং) ক্লাস হয়। অনেক সময় সামার সেমিস্টারে তারা কোনো কোর্স অফার করে না। সাধারণত তিনটা সেমিস্টারে ভর্তির জন্য আলাদা আলাদা আবেদনের সময় থাকে।
তবে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ (যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশের নাগরিক) শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আবেদনের জন্য সবচেয়ে ভালো হলো ফল সেমিস্টার। কয়েকটি কারণে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ শিক্ষার্থীদের জন্য ফল সেমিস্টার সবচেয়ে ভালো।
সাধারণত অন্য সেমিস্টারগুলোর তুলনায় ফল সেমিস্টারে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয় বা বেশি শিক্ষার্থীকে ভর্তির অফার করা হয়।
অধিকাংশ প্রোগ্রামে/ডিপার্টমেন্টে শুধু ফল সেমিস্টারেই ভর্তির সুযোগ থাকে। কিছু ডিপার্টমেন্টে তিনটি বা দুটি সেমিস্টারে ক্লাসের সুযোগ থাকলেও কেবল ফল সেমিস্টারেই ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু প্রোগ্রামে স্প্রিং সেমিস্টারে ভর্তি করালেও সেটা সংখ্যায় কম হয়।
ফল সেমিস্টারেই সাধারণ অধিকসংখ্যক ফান্ড ডিস্ট্রিবিউট করা হয়।
সাধারণত ফল সেমিস্টার থেকে একাডেমিক বর্ষ শুরু হয়। এ সময় ক্লাস শুরু করলে বিভাগের একাডেমিক ইয়ারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্লাস নেওয়া ও শেষ করার সুযোগ থাকে।
ফল সেমিস্টারেই সাধারণত একটা একাডেমিক ইয়ারের সব পরিকল্পনা শুরু হয়। অর্থাৎ একাডেমিক ইয়ার হয় ফল টু স্প্রিং (যেখানে দুই সেমিস্টার) বা ফল টু সামার (যেখানে তিন সেমিস্টার)। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ফল-২০২৩, স্প্রিং-২০২৪ ও সামার-২০২৪, এই তিনটা সেমিস্টার মিলে একটা একাডেমিক ইয়ার।
আবার ফল-২০২৪ থেকে নতুন একাডেমিক ইয়ার শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের/প্রোগ্রামের ভর্তি পরিকল্পনা, ফান্ডিং পরিকল্পনা, সবকিছু ফলকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়। আর ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের সাধারণত এ ফল সেমিস্টারেই একাডেমিক ইয়ারের পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে ফান্ডিং ওফার করা হয়।
ক্ষেত্রবিশেষে স্প্রিংয়েও কিছু ফান্ড ও ভর্তির সুযোগ থাকে, তবে সেটা খুবই কম। কিছু প্রোগ্রামে প্রফেসরের নিজস্ব ফান্ডিং থাকে। সে ক্ষেত্রে প্রফেসর চাইলে কাউকে স্প্রিং সেমিস্টারেও ফান্ডিংসহ ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। তবে এটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এমন হলো যেকোনো বিভাগ বা প্রোগ্রাম বা কোনো প্রফেসর যদি তাদের রিকোয়ার্ড বা টার্গেটেড ছাত্র না পায়, তখন স্প্রিংয়ে নতুন ছাত্র নিয়ে তাদের কোটা পূরণ করে। কারণ, বিভাগকে একটা একাডেমিক ইয়ারে বরাদ্দ করা অর্থ খরচ করতে হয়। তা ছাড়া প্রফেসরদেরও অনেক সময় তাঁর প্রজেক্টের জন্য ছাত্রের দরকার হয়। স্প্রিংয়ে কিছুটা সুযোগ থাকলেও সামারে সুযোগ নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফান্ডিংসহ পিএইচডি ও মাস্টার্স প্রোগ্রামে ফল সেমিস্টারেই ভর্তি করানো হয়।
যেহেতু আমরা দেখেছি বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সঠিক ও সর্বোত্তম সময় হলো ফল সেমিস্টারের জন্য আবেদন করা, তাই এখানে ফল সেমিস্টারের আবেদনের সময়কাল নিয়ে আলোচনা করা হলো। আমরা ইতিমধ্যে বলেছি, ফল সেমিস্টারে ক্লাস শুরু হয় প্রতিবছরের আগস্টে। কিন্তু এ সেমিস্টারে ক্লাস ধরার জন্য আবেদন শুরু করতে হয় প্রায় এক বছর আগে। এ পর্যায়ে আমরা জেনে নিব কখন আবেদনের সময় শুরু হয় এবং কখন শেষ হয়।
সাধারণত ফল সেমিস্টারে (আগস্ট–ডিসেম্বর) ক্লাস শুরু করার জন্য আগের বছরের সেপ্টেম্বর থেকে আবেদন শুরু করতে হয়। উদাহরণ হিসেবে ২০২৪–এর ফল সেমিস্টারের জন্য আবেদন করতে হয় ২০২৩-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪–এর এপ্রিল–মে এ সময়ের মধ্যে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডেডলাইন থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে আবেদনের শুরু ও শেষ সময় বিভিন্ন থাকে। যেমন ২০২৪–এর ফলের জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের শেষ তারিখ ২০২৩–এর ডিসেম্বরের ১ তারিখ, আবার কোথায় ২০২৪–এর এপ্রিলের ১৫ তারিখ বা মে মাসের ১ তারিখ। ফলে আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে চান, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেডলাইন আগে থেকেই জেনে রাখা ভালো। এখানে আরেকটা বিষয় জেনে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের নেটিভ শিক্ষার্থীদের জন্য আবেদনের ডেডলাইন আর ‘ইন্টারন্যাশনাল’ শিক্ষার্থীদের আবেদনের ডেডলাইন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলাদা।
সাধারণত অধিকাংশ পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন প্রক্রিয়া সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই, বিশেষ করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তবে কোথাও কোথাও প্রোগ্রামভেদে পিএইচডিতে আবেদনের সময় ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত থাকে। এ সংখ্যা খুবই কম। আর মাস্টার্স প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক বেশি সময় থাকে। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ এপ্রিল বা ১ মে পর্যন্ত সময় থাকে। তবে ওই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করাই ভালো।
এগুলোর ভর্তির সিদ্ধান্ত পেতে পেতে প্রায় জুন–জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। এটা অনেক সময় জটিলতা তৈরি করে। কারণ, কারও ভর্তি নিশ্চিত হওয়ার পর ভিসাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আগস্টে গিয়ে ক্লাস শুরু করা তখন কঠিন হয়ে যায়। ফলে যত তাড়াতাড়ি আবেদন করা যায়, ততই ভালো। তাই যাঁরা ২০২৪–এর ফলের জন্য আবেদন করতে চান, তাঁদের জন্য এখনই উত্তম সময়।
কেউ যদি ২০২৪–এর ফলে ভর্তি নিয়ে ক্লাস শুরু করে চান, আমি বলব, তাঁদের ২০২৩–এর ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে। আবেদনের আগে আপনার কি কি ডকুমেন্ট ও কি কি জিনিস প্রস্তুত রাখতে হবে, সেটা নিয়ে আমরা পরবর্তী সময় বিস্তারিত আলাপ করব। সেই পর্বে বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনের সময় কি কি জিনিস লাগবে সেটা নিয়েও বিস্তারিত বলব। তবে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য বলছি, ডিসেম্বরের ১ তারিখের আগে আপনার আন্ডারগ্রেড বা মাস্টার্সের সার্টিফিকেট, আইইএলটিএস/টোয়েফল ও জিআরইয়ের স্কোর রেডি রাখলে আবেদন প্রক্রিয়া সহজ হবে।
ঃবি.দ্র. ক্ষেত্রবিশেষে আবেদনের এ প্রস্তুতির সময়কাল পরিবর্তন হতে পারে। মনে করুন, আপনি তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে চান এবং আপনি দেখলেন যে এ তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের ডেডলাইন ফেব্রুয়ারি ১৫। সে ক্ষেত্রে ডেডলাইনের ৮ থেকে ১০ দিন আগে আপনার জিআরই ও আইইএলটিসের স্কোর হলেও আপনি আবেদন করতে পারবেন। এ ছাড়া মনে করুন আপনার আগেই আইইএলটিএসের স্কোর আছে, কিন্তু জিআরই নেই। আপনি ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে এসে চিন্তা করলেন ২০২৪ সালে যেভাবেই হোক আপনাকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনার জন্য রাস্তা খোলা আছে। তখন আপনাকে কষ্ট করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রোগ্রাম জিআরই ওয়েব করেছে এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের ডেডলাইন দীর্ঘ সময় (যেমন এপ্রিল বা মে) পর্যন্ত থাকে, সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। অর্থাৎ কখন আপনাকে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে হবে, তা নির্ভর করে আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবেন সেটার আবেদনের ডেডলাইনের ওপর। তবে আপনি যদি পরবর্তী ফল সেমিস্টারে জন্য বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে চান এবং আপনার প্রত্যাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে চান, সে ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় হলো আগের বছরের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে জিআরই ও আইইএলটিসের স্কোরসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট প্রস্তুত রাখা।
আগামী পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফান্ডিং ও স্কলারশিপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
লেখক: মো. শহিদুল ইসলাম, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র