বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার সঙ্গে অস্তিত্বেরও সংকট

উদ্যোক্তাদের সমিতি ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ২২টিতেই শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে।

বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে ২০১৯ সালের ‘সামার’ সেমিস্টারে ৭৪১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন। পরের বছর সেটা আরও বাড়বে বলেই আশা ছিল। কিন্তু দেখা গেল, করোনার কারণে ২০২০ সালের সামারে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী ভর্তি একেবারেই কমে যায়। ভর্তি হন মাত্র ৮২ জন।

মহামারিকালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে গভীর সংকটে পড়েছে, তার একটি উদাহরণ বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি। তবে শুধু বিজিএমইএ নয়, দু-চারটি বাদে সব কটিতেই শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটে পড়েছে। কেউ কেউ কর্মী ছাঁটাই করেছে। কেউ কেউ বেতন-ভাতা কমিয়েছে।

করোনার কারণে দেশে গতবছর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে সরাসরি ক্লাস না হওয়ায় দেশে সার্বিক শিক্ষা নিয়েই নানা ধরনের বড় সংকট তৈরি হয়েছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সংকট দ্বিমুখী; একদিকে শিক্ষার, অন্যদিকে অস্তিত্বের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় মেটানো হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টিউশন ফি দিয়ে। ভর্তি কমে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় অনেকাংশেই কমেছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত তিন বছরের সামার সেমিস্টারে ছাত্র ভর্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে দেখা যায়, ২২টিতেই শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে। বেড়েছে মাত্র দুটিতে। একটিতে অপরিবর্তিত। শিক্ষার্থী বেড়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বিইউবিটিতে)।

দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটি ১০৭টি। এর মধ্যে ৯৭টির কার্যক্রম চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে তিন লাখ। শিক্ষক রয়েছেন ১৬ হাজারের কিছু বেশি। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন যত শিক্ষার্থী পড়েন (অধিভুক্ত কলেজ বাদে), তার ৪৩ শতাংশের সমপরিমাণ পড়েন বেসরকারিতে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সংকটটি গভীর। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নতুন স্থাপিত, সেগুলোর এখন টিকে থাকাই দায়। তিনি বলেন, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বাড়ি ভাড়া দেওয়া ও অন্যান্য পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ জন্য তাঁরা সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকে থাকার জন্য আর্থিক প্রণোদনা চায়, যা পরে পরিশোধ করা হবে।

শেখ কবির হোসেন আরেকটি সমস্যার কথা বলেন, সেটি হলো, কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। ফলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ভর্তি কম হওয়ার মোটা দাগের কয়েকটি কারণ জানা গেছে। প্রথমত, করোনার মধ্যে অনলাইনে নামকাওয়াস্তে ক্লাস করার চেয়ে এক-দুই সেমিস্টার বিরতি দেওয়াকেই ভালো মনে করছেন কেউ কেউ। শিক্ষার্থীদের একাংশের পরিবার করোনার মধ্যে আর্থিক টানাপোড়েনে রয়েছে। এইচএসসি মূল্যায়নের ফল প্রকাশ দেরির কারণেও শিক্ষার্থী পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সংকট বিপাকে ফেলেছে শিক্ষক ও কর্মচারীদের পরিবারকেও। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ছাঁটাই ও সুযোগ-সুবিধা কমানোর খবর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তি কমে যাওয়ায় অনেক কর্মীর কাজ কমে গেছে। তাই কর্তৃপক্ষ তাঁদের ছুটিতে পাঠিয়েছে। ছুটিতে পুরোপুরি বেতনও দেওয়া হচ্ছে না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত বছরের মে মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস, মূল্যায়ন, ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও অনুমতি পাওয়ার পর কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনো যে খুব একটা ভালো চলছে, তা-ও বলা যাবে না। শিক্ষার মান এগিয়ে থাকা এবং আর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই মূলত ভালো করছে।

সার্বিক বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে পড়াশোনা আর ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে পড়াশোনা এক নয়। সরাসরি ক্লাসে অনেক বেশি মিথস্ক্রিয়া হয়, বোঝাপড়া ভালো হয়।