শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি সামলে কবে আবার শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরতে পারবেন, কেউ জানে না। ক্যাম্পাস খোলার দিনটি নিয়ে কী ভাবছেন শিক্ষার্থীরা?
সাদিয়া সালসাবিল, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ
বাইরে ঝুমবৃষ্টি। যেখানে বসে আমি এখন লেখাটা লিখছি, সেখান থেকে কয়েক শ কিলোমিটার দূরে আমার মনকে নিয়ে যাচ্ছে এই বৃষ্টি! অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ ক্যাম্পাসের কথা কেন যেন একটু বেশিই মনে পড়ছে। এমন এক ঝুমবৃষ্টিতে হয়তো খালি পায়ে টুপ করে বের হয়ে পড়ব বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাসে। আমাদের মেডিকেল কলেজে খুব সুন্দর একটা লেক আছে। হল থেকে বের হলেই লেক। কাকভেজা হয়ে ঘুরে বেড়াব ক্যাম্পাসজুড়ে।
বৃষ্টির সময় ক্যাম্পাসটাকে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। ক্যাম্পাসের বাগানবিলাসগুলোকে কত দিন হয়ে গেল দেখি না…।আবার যেদিন ক্যাম্পাসে ফিরে যাব, মনে হবে ঠিক যেন প্রথম বর্ষে ভর্তি হলাম। পার্থক্য শুধু এই যে এবার মুখগুলো পরিচিত। লেকের পাড়ে বসে আড্ডা, গান, আরও কত কী!প্রতিদিন অনলাইনে ক্লাস চলছে। এত কিছুর মধ্যেও পড়াশোনা, পরীক্ষা কিছুই থেমে নেই। ক্লাসরুমে বসে ক্লাস করা আর এই ভার্চ্যুয়াল জগতের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।
একদিন আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আবার ক্লাসরুমগুলো সবার পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠবে, ক্লাস শেষে আবার সেই আড্ডা। কিছু একটা হলেই হুটহাট দল বেঁধে বাইরে খেতে যাওয়া কিংবা ঘুরে বেড়ানো।আমাদের কলেজে সাপ্তাহিক ছুটি মঙ্গলবার। সে হিসেবে সোমবার রাত আমাদের কাছে অনেকটা চাঁদরাতের মতো। এই রাতের বিশেষত্ব হচ্ছে পরের দিন ক্লাস, আইটেম, এসবের কোনো চিন্তা থাকে না। আড্ডা আর খেলাধুলায় যেন মেতে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। কত দিন হয়ে গেল মাঝরাতে দল বেঁধে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ানো হয় না।
বাসায় অনলাইন ক্লাস হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেই চাঁদরাতের আমেজ কি আর হালের জুম ক্লাসে মেলে?মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষ নিয়ে সব শিক্ষার্থীর মধ্যেই একরকম রোমাঞ্চ কাজ করে। প্রথম প্রথম ওয়ার্ডে গিয়ে ক্লাস করার অনুভূতিই অন্য রকম! সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে প্রিয় সাদা অ্যাপ্রোন পরে আমরা কবে যেতে পারব, সেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি।কলেজে কোনো ক্রিকেট বা ফুটবল টুর্নামেন্ট হওয়া মানেই সবাই একসঙ্গে দেখতে যাওয়া। সারা দিন মাঠে বসে নিজ নিজ দলকে সমর্থন দেওয়া। আর বাংলাদেশের কোনো ম্যাচ হলে তো কথাই নেই! সবাই একসঙ্গে বসে খেলা দেখার যে মজা, ওটা কি আর বাসায় বসে পাওয়া সম্ভব?
আমাদের কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাম হলো ‘দ্যুতি’। সারা বছর অপেক্ষার প্রহর গুনে ‘দ্যুতি’-র সময় যখন আসে, ক্যাম্পাসটা মনে হয় নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও যোগ দেন ‘দ্যুতি’-র এই সুন্দর সময়ে। বাঙালি, কাশ্মীরি, নেপালি আর ভারতীয় সব শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা একটা অন্য মাত্রা যোগ করে অনুষ্ঠানে।
খন্দকার মাহিন আরাফাত, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ঢাকা
যেদিন ক্যাম্পাস খুলে যাবে, সেদিন আর আমি ঘরে ফিরব না। সকাল থেকে সন্ধ্যা দুরন্ত কিশোরের মতো ছুটে বেড়াব ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোনায়। বুকভরে নিশ্বাস নেব। কখনো ক্লাসরুম, কখনোবা মাঠে খুঁজে ফিরব ফেলে আসা স্মৃতি। সেদিন নতুন করে আরেকবার আবিষ্কার করব আমার প্রিয় ক্যাম্পাসকে। ছুঁয়ে দেখব চেনা দেয়াল, চেয়ার, মাঠের সবুজ।
সেদিন নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠতে আর অ্যালার্ম লাগবে না। অন্য দিনের মতো ক্লাসে পৌঁছাতে আর দেরিও হবে না। সবচেয়ে আগে ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর রেকর্ডও করে ফেলতে পারি!সেদিন আমিই হয়তো হব ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্র।
২১ ইঞ্চি স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে ক্লাস করতে করতে হাঁপিয়ে গেছি। আবার সত্যিকার ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়ার দিনটা কত প্রাণবন্ত হবে, ভেবেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি।ক্যানটিনের দোতলায় বন্ধুদের নিয়ে খাওয়ার আয়োজন তো হবেই। আবারও এক প্লেট খিচুড়ি আর ডিমের তরকারি নিয়ে ভাগাভাগি করে খাওয়ার দৃশ্যটা চোখে পড়বে। তবে সেদিন আর আগের মতো আমাদের মধ্যে ঝগড়া হবে না। ওই এক প্লেট খিচুড়ি আর ডিম দিয়েই খাব তৃপ্তি করে। তবে সেই পুরোনো দিনের মতো দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের মতো ডিমের ঝোল চাওয়ার লোভ সামলাতে পারব না।
অনেক দিন পর আবারও ক্যাম্পাসের টং দোকানে আমাদের আড্ডা বসবে। চায়ের কাপ হাতে আমাদের সেই আড্ডা ঢাকা থেকে সুদূর মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে গেলেও অবাক হব না। সেদিন পুরোনো বন্ধুদের মতো ক্যাম্পাসের গাছ, লতাপাতা বা পশুপাখিরাও হয়তো আমাকে জড়িয়ে নেবে। মাঠের সবুজ ঘাসে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে হয়তো চোখ বুজে আসবে।
ফারিহা বিনতে ফারুক, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
যেদিন ক্যাম্পাস খুলে যাবে সেদিন আমার চেয়ে অসুখী আর কেউ হবে না। আশ্চর্যজনক, তা-ই না? তা বটে, কিন্তু কেন? হাজারো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস খোলার অপেক্ষায় আছে। কেউবা এক সেমিস্টারের জন্য পাস করে বেরোতে পারছে না। হয়তো কারও কারও ইচ্ছা ছিল প্রথম বেতন দিয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। বলবে, 'বাবা, তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও তো। আর এই নাও তোমাদের উপহার। আমি চাকরি করছি তো, তুমি শুধু শুধু কেন কষ্ট করবে? আমি আর ছোট্ট নেই...' সেই অপেক্ষা শুধু দীর্ঘায়িতই হচ্ছে।
শুধু কি তা-ই? অনেক ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন শহরের প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা হওয়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল ক্যাম্পাস। গত এক বছরের বেশি সময়ে ক্যাম্পাসের মাটি থেকে তাঁদের চিহ্ন মুছে গেছে বললেই চলে। কয়টা সম্পর্ক টিকে আছে, এ নিয়ে অবশ্য কোনো গবেষণা চোখে পড়েনি!
এত মানুষের এত আকাঙ্ক্ষা, তাহলে আমার কেন ক্যাম্পাসের প্রতি এতই তিক্ততা? কারণ যেদিন ক্যাম্পাস খুলে যাবে, সেদিন থেকে আবার বিশাল দূরত্ব হয়ে যাবে মা-বাবার সঙ্গে। এই মহামারিতে যেন আবার শিশু হয়ে গিয়েছিলাম। সব সময় মা-বাবার কাছে থাকার বেশি প্রয়োজন বোধ করেছি। পড়ালেখার জন্য বাসা থেকে দূরে থাকতে হতো। মহামারি এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে।
ক্যাম্পাস খুলে গেলে এই শহরে আর হাঁটা হবে না আমার। তখন হাঁটতে হবে অন্য শহরে। রাতে একা তালা খুলে ক্লান্ত শরীরে পরিবারের ছবি হাতে নিয়ে ভাবতে হবে—'এই তো, আর তো মাত্র দুটি পরীক্ষা বাকি! এরপর আমি বাসায়, আমার জগতে। যেখানে পা বাড়ালেই পাওয়া যায় আমার কাছের মানুষের গন্ধ! এই শহর শুধুই আমার।'
মহামারি আমার কাছে স্বপ্নের মতো! ক্যাম্পাস খুলে যাওয়া মানে স্বপ্ন ভেঙে আবার বাস্তবে পা দেওয়া। আর বাস্তব বড়ই বেরসিক। যেদিন ক্যাম্পাস খুলে যাবে, আবার মলিন হয়ে যাবে আমার জীবন!