বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে ভারতীয়দের আধিপত্য বাড়ছে দিনকে দিন। গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো বৃহৎ প্রযুক্তি জায়ান্ট পরিচালিত হচ্ছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) নেতৃত্বে। এ দুই মার্কিন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বহুজাতিক নানা প্রযুক্তি জায়ান্টের শীর্ষ পদে ভারতীয়দের উপস্থিতি বাড়ছে। মাইক্রোসফট, আইবিএম, অ্যাডোবের শীর্ষ পদেও আছেন ভারতীয়রা। বিশ্বের অন্যতম ১৬টি শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এখন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এবার এঁদের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
সুন্দর পিচাই। ভারতের হায়দরাবাদের এই পড়ুয়া এখন গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশনের সিইও। তিনি ২০১৯ সাল থেকে এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ভারতের আইআইটির খড়গপুরের সাবেক শিক্ষার্থী এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে গুগলের প্রধান হন। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সুন্দর পিচাই গুগলে কাজ করার সময়ে অ্যান্ড্রয়েড, ক্রোম, গুগল ম্যাপস নিয়ে কাজ করেছেন। আর এর সুফল পাচ্ছেন সবাই। সুন্দর পিচাই এমএস করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড থেকে। আর এমবিএ করেছেন একই দেশের ওয়ার্টন থেকে।
ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যর রাজধানী হায়দরাবাদে জন্ম সত্য নাদেলার। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাইক্রোসফটের সিইও হন তিনি। কয়েক দিন আগে তাঁকে মাইক্রোসফটের চেয়ারম্যানও করা হয়। এর আগে সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন জন টমসন। সংস্থার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত, যেমন লিঙ্কডইন, নুয়্যান্স কমিউনিকেশনস, জেনিম্যাক্স ইত্যাদি অধিগ্রহণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সত্য নাদেলার বাবা আইএএস অফিসার ছিলেন। মা সংস্কৃতের অধ্যাপক।
কর্ণাটকের মণিপল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে সত্য নাদেলা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নেন। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে এমএস করেন ১৯৯০ সালে। দুই বছর সান মাইক্রোসিস্টেমসে কাজও করেন। ১৯৯২ সালে যোগ দেন মাইক্রোসফটে। এরপর ১৯৯৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব চিকাগো থেকে এমবিএ করেন।
মার্কিন কম্পিউটার সফটওয়্যার কোম্পানি অ্যাডোবি ইনকরপোরেশনের সিইও শান্তনু নারায়ণ। তিনি এর চেয়ারম্যান এবং প্রেসিডেন্ট। শান্তনু নারায়ণও দক্ষিণ ভারতের হায়দরাবাদের। ১৯৯৮ সালে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাডোবিতে যোগ দেন। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এবং ২০০৭ সালে সিইও হন অ্যাডোবির।
হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক করা শান্তনু ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। এমএস করেন বউলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। অ্যাডোবিতে যোগদানের আগে অ্যাপল ও সিলিকন গ্রাফিকস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছিলেন।
গত বছরের এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনসের (আইবিএম) সিইও হিসেবে দায়িত্ব পান ভারতের অরবিন্দ কৃষ্ণা। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে জন্ম নেওয়া অরবিন্দ ১৯৯০ সাল আইবিএমে চাকরি শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, কানপুর থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক শেষ করেন তিনি। এরপর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। আইবিএমে দীর্ঘ তিন দশকের চাকরিজীবনে একাধিক জ্যেষ্ঠ পদে কাজ করেন।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ চুক্তিভিত্তিক ইলেকট্রনিকস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্লেক্স লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের সিইও তিনি। ২০১৯ সালে ফ্লেক্সের সিইওর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ভারতের বিড়লা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স থেকে স্নাতক রেভাতি। এ ছাড়া থান্ডারবার্ড স্কুল অব গ্লোবাল ম্যানেজমেন্টে এমবিএ করেন।
মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি পালো আলতো নেটওয়ার্কসের সিইও হিসেবে ২০১৮ সালে যোগ দেন নিকেশ অরোরা। এর আগে তিনি গুগল ও সফটব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ সামলেছেন। নিকেশ অরোরা ভারতের বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। এ ছাড়া তিনি নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ এবং বোস্টন কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন।
মার্কিন কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং কোম্পানি অ্যারিস্টা নেটওয়ার্কসের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও জয়শ্রী উল্লাল। ২০০৮ সাল থেকে এ দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী। ২০১৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় অ্যারিস্টা নেটওয়ার্কস। জয়শ্রী সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক এবং সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। অ্যারিস্টা নেটওয়ার্কসে যোগ দেওয়ার আগে সিসকো এবং অ্যাডভান্সড মাইক্রো ডিভাইসেসে (এএমডি) কাজ করেছিলেন তিনি।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরাগ আগারওয়াল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বোম্বে থেকে স্নাতক করেন। ২০১১ সালে টুইটারের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তার (সিটিও) দায়িত্ব পান পরাগ আগারওয়াল। টুইটারে যোগ দেওয়ার আগে মাইক্রোসফট, এটিঅ্যান্ডটি এবং ইয়াহুর রিসার্চ টিমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।
ভিডিও হোস্টিং, শেয়ারিং এবং সার্ভিসেস প্ল্যাটফর্ম ভেমিও একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সিইওর দায়িত্ব পালন করছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অঞ্জলি সুদ। ওপেন ভিডিও প্ল্যাটফর্ম সেবাদাতা ভেমিওতে যোগ দেওয়ার আগে বৈশ্বিক ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন এবং টাইম ওয়ার্নারে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন অঞ্জলি।
সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি মাইক্রোন টেকনোলজি ইনকরপোরেশন একটি মার্কিন কোম্পানি। এর সিইও সঞ্জয় মেহরোত্রা। মেমোরি চিপ নির্মাতা স্যানডিস্কের সহপ্রতিষ্ঠাতা এই ভারতীয়। এ ছাড়া ওয়েস্টার্ন ডিজিটালের বোর্ড সদস্য ছিলেন তিনি। স্যানডিস্ক প্রতিষ্ঠার আগে ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস টেকনোলজি এবং ইন্টেলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করেন সঞ্জয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেহরোত্রা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন।
২০১৫ সালে মার্কিন ক্লাউড ডাটা সার্ভিসেস এবং ডাটা ব্যবস্থাপনা কোম্পানি নেটঅ্যাপের সিইও এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান ভারতীয় বংশোদ্ভূত জর্জ কুরিয়ান। নেটঅ্যাপে যোগ দেওয়ার আগে তিনি সিসকো সিস্টেমস, আকামাই টেকনোলজিস এবং ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানিতে কাজ করেন।
জর্জ কুরিয়ান আইআইটি মাদ্রাজে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ছয় মাসের মধ্যে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। সেখান থেকে তিনি তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এ ছাড়া তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেন।
২০০৫ সালে পিপলসফটের প্রতিষ্ঠাতা ডেভ ডুফিল্ডকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন অন-ডিমান্ড ফিন্যান্সিয়াল ব্যবস্থাপনা এবং হিউম্যান ক্যাপিটাল ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার ‘ওয়ার্কডে’ প্রতিষ্ঠা করেন অনিল ভুশ্রি। ওয়ার্কডের সিইওর দায়িত্বে আছেন তিনি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ টেক নির্বাহী ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন।
১৯৮৯ সালে স্টিভ সাংঘীর হাত ধরে যাত্রা শুরু মাইক্রোচিপ টেকনোলজি করপোরেশনের। এর দুই বছর পর ১৯৯১ সালে মাইক্রো-কন্ট্রোলার, মিক্সড-সিগন্যাল, অ্যানালগ এবং ফ্ল্যাশ-আপি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির সিইওর দায়িত্বে বসেন তিনি। ভারতের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে সাংঘী। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেন।
মার্কিন ডোমেইন নিবন্ধন ও ওয়েব হোস্টিং কোম্পানি গোড্যাডির সিইওর দায়িত্ব ২০১৯ সালে পান আমান ভুটানি। গোড্যাডিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি এক্সপেডিয়ায় একাধিক পদে কাজ করেন। এসভিপির ওয়ার্ল্ড ওয়াইডে প্রকৌশল বিভাগেও কাজ করেন তিনি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করে ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন আমান।
বহুজাতিক সফটওয়্যার কোম্পানি ক্যাডেন্স ডিজাইন সিস্টেমসের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ২০১৮ সালে পান অনিরুদ্ধ দেবগান। ক্যাডেন্স ডিজাইনে যোগ দেওয়ার আগে ম্যাগমা ডিজাইন অটোমেশন এবং ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনসে (আইবিএম) দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন তিনি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি দিল্লি থেকে স্নাতক করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন।
মার্কিন কম্পিউটার হার্ডডিস্ক ড্রাইভ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ডিজিটাল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিবা শিবারাম। ওয়েস্টার্ন ডিজিটালে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ইন্টেল, ম্যাট্রিক্স সেমিকন্ডাক্টরস এবং স্যানডিস্কের একাধিক পদে দায়িত্বে ছিলেন। শিবারাম ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ত্রৈউচি থেকে স্নাতক ডিগ্রি এবং রেনসেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। সূত্র: গ্যাজেটস নাউ