আর দশটা স্বাভাবিক দিনের মতোই এ বছর ঈদের দিন কেটেছে মোহাম্মদ আলজাজ্জারের। ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের চূড়ান্ত বর্ষে পড়ছেন এই ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী। ফিলিস্তিনে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ছুটিতে দেশে ফেরার সুযোগ পাননি। এদিকে করোনা মহামারির কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও দেখা হয় না বহুদিন। কলেজের মসজিদে ঈদের নামাজের পর ছাত্রাবাসের চার দেয়ালের মধ্যেই কেটেছে তাঁর ঈদের দিন।
উচ্চশিক্ষার জন্য ফিলিস্তিনের ওয়েস্টব্যাংকের হেবরন শহর থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আসেন আলজাজ্জার। তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে ঈদের কোনো আনন্দ ছিল না। খুবই মন খারাপ ছিল সেদিন। আমাদের দেশে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, বোমা বিস্ফোরণে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিনিয়ত টিভি ও ফেসবুকে এসব দৃশ্য দেখার পর থেকে ভীষণ উদ্বেগে কেটেছে দিন।’
ফিলিস্তিনের গাজার পরিস্থিতি জানার জন্য সপ্তাহখানেক আগে সেখানকার বন্ধু আবদুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন মোহাম্মদ আলজাজ্জার। তিনি বলেন, ‘ফোনের এপাশ থেকেই আমি সেখানকার গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল, সেটি নিশ্চয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
‘ফোনের এপাশ থেকেই আমি সেখানকার গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল, সেটি নিশ্চয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার্থে আসা ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের সংগঠন জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টিনিয়ান স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের ১২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। মূলত, চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়েন তাঁরা। এর মধ্যে শুধু বরিশালের শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজেই রয়েছেন প্রায় ৩০ জন।
দূর দেশে পড়তে এসেছেন। মা-বাবার ফোন এলে মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ বাড়ির ফোন পেলে ফিলিস্তিনি এই শিক্ষার্থীরা দুর্ভাবনায় পড়ে যান। কোনো খারাপ খবর এল না তো?
ফিলিস্তিনের গাজায় জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ আতিয়ার শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। গাজায় তাঁর বাড়ির আশপাশে ব্যাপক বোমা হামলা হয়েছে। আতঙ্কে আতিয়ারের পরিবার নিজেদের বাড়ি থেকে পালিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। উৎকণ্ঠা নিয়ে আতিয়ার বলেন, ‘জানি না সেখানেও তাঁরা কতটা সুরক্ষিত থাকবেন। সব সময়ই তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তা হয়। আমাদের বাড়ির এলাকা “রেড জোন”। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ি থেকে বের হয় না। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও করতে পারছি না।’
একই শহর থেকে বাংলাদেশে পড়তে আসা তালাল আলনাদি সিলেট এম এ জি ওসমানি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। ফিলিস্তিনে চলমান যুদ্ধে আলনাদির চাচার বাড়িতে হামলা হয়েছে। গৃহহীন হয়ে তাঁর চাচা এখন দাদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আলনাদি জানান, তাঁর পরিবার এখন পর্যন্ত নিরাপদে আছে। তবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘কত দিন তারা নিরাপদ থাকবে জানি না। আসলে গোলাগুলি, বোমা হামলা, আকস্মিক মৃত্যু—এসব আমাদের জন্য খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
সিলেটের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। সেখানকার আরেক শিক্ষার্থী রাজিন ফখর কোদেয়াহ জানান, তাঁর কলেজের তিনজন শিক্ষার্থী মাসখানেক আগে ছুটিতে ফিলিস্তিন গিয়েছিলেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওই তিন শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবার নিরাপদে আছে।
তবে রাজিন বলেন, ‘ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আমার বন্ধুদের বাংলাদেশে ফিরতে কত দিন সময় লাগতে পারে, সেটি নিশ্চিত নই। জরুরি কিছু না হলে স্বাভাবিক সময়েও আমরা ছুটিতে দেশে যাই না। কারণ, ফিলিস্তিনের অনেক সীমান্ত ইসরায়েলের দখলে। এ কারণে ওই নিরাপত্তাচৌকিগুলো পার হয়ে আবার বাংলাদেশে আসা বেশ কঠিন।’
ফিলিস্তিনের সহপাঠীদের এই দুঃসময়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের স্থানীয় বন্ধুরা নিয়মিত তাঁদের খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানালেন বরিশালের শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাইতাম। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের বন্ধুরা অনেকেই নিয়মিত ফোন করছে। তারা আমার পরিবারের খোঁজখবর জানতে চাইছে। আমার তিন বাঙালি সহপাঠী জাহিদুল, বায়েজিদ, নাফিজ হোস্টেলে এসে আমার সঙ্গে দেখাও করেছে। বাঙালি বন্ধুদের এই ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।’
যুদ্ধের পরিস্থিতি অবসানের জন্য বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন হাইতাম। মানবতার কথা বিবেচনা করে ফিলিস্তিনের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন তিনি। এমবিবিএস সম্পন্ন করেই হাইতাম তাঁর দেশে ফিরে যেতে চান। চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের সেবা করতে চান তিনি। হাইতামের বিশ্বাস, তত দিনে ফিলিস্তিনে শান্তি ফিরে আসবে। যুদ্ধাহত কোনো মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না আর।