ক্যাম্পাস বন্ধের এই সময়টাতে না পড়া বইগুলো হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। শুধু যে একটা সুন্দর সময় কাটছে তা নয়, কিছু কিছু বই দিচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস। তেমন কিছু বইয়ের কথা লিখেছেন শিক্ষার্থীরা।
মাহমুদুল মুন্না
চতুর্থ বর্ষ, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
'আপনি বেঁচে আছেন!'
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশা তার জীবনের শেষ গ্রন্থ ‘রাইফেল রোটি আওরাত’-এ এই প্রশ্নটি করেছিলেন।কারণ মৃত্যু যেখানে অবধারিত, সেখানে বেঁচে থাকার প্রশ্নটিই যে সবচেয়ে বড়!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীনকে কেন্দ্র করে লেখক বর্ণনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভকালীন সময়ের বিভীষিকাময় চিত্র। বেঁচে থাকার তাগিদে সুদীপ্ত ছুটেছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, যেখানে প্রতিরাতেই অনিশ্চিত ছিল আগামী দিনের সূর্যোদয় দেখা।
লেখকের বর্ণনায় মৃত্যুপুরীর মধ্যেও মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে এভাবে, ‘...কেবল একটা শূন্যতার, একটা ভয়ংকর অনিশ্চয়তার দ্বীপে তারা বন্দী। এর নাম বেঁচে থাকা?’
বাঙালির অনুপ্রেরণার উৎস, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, সম্ভ্রম হারানো বাঙালি নারীর বুকে মাইন বেঁধে হানাদার বধ করার দৃষ্টান্তগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসা ও বিশ্বাস যে বাঙালিদের পথ দেখাতে পারে—সেটিও তুলে ধরেছেন লেখক। স্বাধীনতাকামী বাঙালি মনের আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর শঙ্কার এক নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠছে এই উপন্যাসে।
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে যখন আমরা চার দেয়ালে বন্দী হয়ে আছি—এমন প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাসটি পড়ে শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর সাহিত্যজ্ঞানই সমৃদ্ধ হয়নি, সঙ্গে এমন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মনের সমস্ত শক্তি জাগ্রত করে, নতুন প্রভাতের আশায় কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার সাহসও পেয়েছি।
ঘাতক দালালদের হাতে অপহৃত ও নিহত হওয়ায় বিজয়ের প্রথম সূর্যোদয় লেখক দেখে যেতে পারেননি। তবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য আশায় বুক বেঁধে উপন্যাসের ইতি টেনেছিলেন এইভাবে, ‘পুরোনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে।আহা তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কত দূরে। বেশি দূরে হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মা ভৈঃ। কেটে যাবে।’
মেহরীন নেওয়াজ
চতুর্থ বর্ষ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মানুষ হওয়া বলতে আমরা কী বুঝি? সেপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড এই বহু পুরোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। বইটি ঠিক গল্পের মতো লাগে না, মনে হয় মানবজাতির ইতিহাসের একটি সফরের মধ্য দিয়ে গেলাম। কীভাবে ১০ হাজার বছর আগের ছয়টি মানব প্রজাতির মধ্য থেকে আমাদের পূর্বপুরুষের জিনোমেরই লক্ষ কোটিবার প্রতিলিপি তৈরি হলো, আর সেই প্রজাতিই পৃথিবীজুড়ে তাদের আধিপত্য ছড়াল, তার একটা বিস্তৃত বিবরণ এই বইটি।
কিন্তু লেখাটি নিছক একটা ইতিহাসের পাঠ না। ১০ হাজার বছর আগের হোমো সেপিয়েন্সদের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় বারবার। ভীষণ অসম্ভবের ভেতরেও নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার যে অলৌকিক ক্ষমতা মানবজাতির আছে, তা হাজার হাজার বছর আগে থেকে প্রমাণিত হয়ে আসছে। আমরা তা প্রমাণ করছি আজও ধরাছোঁয়ার বাইরের এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে।
জগতে মানবজাতির অস্তিত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময়ের হলেও এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। বইটিতে মোটামুটি তিনটি মুখ্য আন্দোলনকে দায়ী করা হয় আমাদের আজকের অবস্থানের জন্য—কগনিটিভ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব। জৈবিকভাবে তুচ্ছ একটা প্রজাতির ৭০ হাজার বছর যুদ্ধ করে আজ পর্যন্ত টিকে থাকাটাই এক অদম্য কীর্তি। সেখানে শুধু বেঁচে থাকাই নয়, অন্য সব প্রজাতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতেও সক্ষম হলাম আমরা। এত সাফল্যের মুখে দাঁড়িয়েও কত অসন্তুষ্টি। লেখকের মতে এটি আমাদের সবচেয়ে ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য—আমরা কী চাই তা আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
প্রজাতি হিসেবে আমরাও একেবারেই নির্দোষ না। যুগ যুগ ধরে একের পর এক অবিচার করে এসেছি প্রকৃতির সঙ্গে। বিনিময়ে প্রকৃতিও আমাদের উপহার দিয়েছে অন্তহীন প্রতিকূলতা। আদিযুগের প্রকাণ্ড ম্যামথের থেকে আজকের প্রতিকূলতাগুলো বেশ ভিন্ন। কালের সঙ্গে পরিবর্তন হয় প্রতিপক্ষ, মানচিত্র, জীবনধারার। কিন্তু সেপিয়েন্স প্রজাতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়নি একটা জিনিস—টিকে থাকার প্রক্রিয়া। য়ুভাল নোয়া হারারি বইটিতে বলেন, বেঁচে থাকার কোনো একক প্রাকৃতিক পথ নেই। মানিয়ে নেওয়ার এই আশ্চর্য ক্ষমতার জন্যই 'স্বাভাবিক' বলতে সেপিয়েন্সদের জীবনে কিছু নেই। কালের প্রয়োজন যা, তা-ই আমাদের স্বাভাবিক। ৭০ হাজার বছর ধরে নতুন নতুন 'স্বাভাবিক' জীবনধারার উদ্ভাবন করেই মানবজাতি এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে চলবে।
মাইশা চৌধুরী
তৃতীয় বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
নন–ফিকশন বই সাধারণত খুব একটা পড়া হয় না। তবে এই করোনাকালে অনেকগুলো পড়া হয়ে গেল। শেষ যে বইটা আমার জীবনে প্রভাব ফেলেছে, সেটা হলো লিলি সিংয়ের লেখা হাউ টু বি আ বাওজ। লিলি সিংকে আমরা মূলত ইউটিউবার হিসেবে চিনি, সুপারউইমেন নামে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। অনুপ্রেরণাদায়ী বইগুলো একটা পর্যায়ে গিয়ে অনেক সময় একঘেয়ে হয়ে যায়। এই বইটিতে তেমন একটি অধ্যায়ও নেই। প্রতিটি অধ্যায় পড়ার পরই নিজের মধ্যে অন্য রকম ইতিবাচক শক্তি টের পেয়েছি।
যখন থেকে নিজের কিছু করা শুরু করেছি, তখন থেকে অনেক রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি। এই বইটা আমাকে খুব সাহায্য করেছে। বইতে একটা কথা ছিল—'ডোন্ট গিভ আপ বিফোর ইউ ইভেন ট্রাই'। অর্থাৎ চেষ্টা করার আগেই হাল ছেড়ে দিয়ো না। কথাটা আমি হৃদয়ে ধারণ করতে চেষ্টা করছি।
এখন আমরা সবাই রীতিমতো ভয়ংকর একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ রকম একটা সময়ে ইতিবাচক শক্তি আমাদের খুব প্রয়োজন। 'জীবনের খারাপ সময়টাকে টাকা হিসেবে ধরুন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু শেখার বিনিময়ে এই টাকা দিয়েই আপনি মূল্য পরিশোধ করবেন।' লিলি সিংয়ের মনস্তত্ত্ব অনেকটা এ রকম।
আমরা যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, কিংবা যে সময় অতিবাহিত করছি, এটা আমাদের জন্য অস্বস্তিকর। কিন্তু ঠিক এই সময়টাকেও যদি আমরা ভিন্নভাবে গ্রহণ করতে শিখি—এ থেকে জীবনের অনেক জটিল শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে।
কার সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়—এই বই পড়ে আমি শিখেছি। 'তুমি যদি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো, তাদের প্রতি তোমার প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করো।' সব সময় আমরা মানুষের কাছ থেকে মনের মতো ব্যবহার পাব, এমনটা আশা করা বোকামি। মানুষের ব্যবহারের বিপরীতে কেমন ব্যবহার করব—নিজেকেই ঠিক করতে হবে।
মো. আফজাল হোসেন
দ্বিতীয় বর্ষ, যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি
'সমাজ কী বলবে'—ভাবার চেয়ে 'আমার ভেতরটা কী বলবে'—সেটা ভাবাই আমি শ্রেয় বলে মনে করি। বর্তমান সময়ের ভীষণ স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো গর্ভপাত। সামাজিক বলয়, আত্মসম্মান অথবা খেয়ালখুশির জেরে কত প্রাণ এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা চাইলেও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ করে পেরে ওঠেন না। বিখ্যাত ইতালিয়ান সাংবাদিক ও লেখক ওরিয়ানা ফালাচির লেখা আ লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্ন বইটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, একটি অনাগত প্রাণ অনাগত ভবিষ্যতের সম্ভাবনা হতে পারে।
ফালাচি হাজার প্রতিকূলতা সহ্য করে, নিজের ক্যারিয়ারের কথা না ভেবে একটি শিশুকে জন্ম দেওয়ার ইচ্ছায় পথ হাঁটতে শুরু করেন। মা–বাবা, বন্ধুবান্ধব, বাচ্চার বাবাসহ সবাই গর্ভপাত করতে বললেও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। একাই লড়ে গেছেন। ইঞ্চি ইঞ্চি করে বেড়ে ওঠা অনাগত সন্তানের কাছে কত কী যে বলেছেন ফালাচি। উদাহরণ দিই।
'ভালোবাসা নিয়ে অন্য একদিন তোমার সঙ্গে কথা বলব। আমি এখনো জানি না ভালোবাসা কী। এখন মনে হয় এটি একটি তামাশা, যা অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত রাখার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে।'
'তোমার আর আমার এক অদ্ভুত জুটি। আমার ওপর তোমার আর তোমার ওপর আমার সবকিছু নির্ভর করে। আমার মৃত্যু মানে তোমার মৃত্যু। কিন্তু আমরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না, তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারি না।'
একজন মা একা ঠিকই লড়ে যেতে পারেন সারা পৃথিবীর সঙ্গে, কিন্তু তাঁর কষ্টটাই গর্ভে থাকা প্রজন্মের মাধ্যমে অভিশাপ হয়ে পৃথিবীর কাছে ফিরে আসে। ফালাচি দুটো দিকই নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর এই বইয়ে।
করোনাকালীন এই দুঃসময়ে বইটি পড়ে আমি জেনেছি—প্রতিটি প্রাণ আমাদের পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ। ঘৃণ্য গ্রহের পরিচয়টাকে উল্টো করে একটা নতুন জীবনকে পবিত্র ও নির্ভরযোগ্য গ্রহের পরিচয় দেওয়াই হবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।