শিক্ষকতা এক মহান পেশা। দেশ ও সমাজে শিক্ষক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার পাত্র। শিক্ষকেরা সভ্যতার অভিভাবক, সমাজ সংগঠক, সমাজের প্রতিনিধি এবং দেশ গঠনকারী। তাঁরা শিক্ষার্থীকে চরিত্র গঠনে, নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি বিকাশে এবং সমাজ বিবর্তনের অনুঘটক ও সুশীল সমাজ তৈরির প্রধান সহায়ক। কিন্তু যে শিক্ষকেরা জাতি গঠনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন, সেই মানুষ গড়ার ‘আসল কারিগর’ প্রাথমিক শিক্ষকেরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও সামাজিক দিক দিয়ে এখনো অনেকটাই অবহেলিত।
পাঠ্যপুস্তকের লেখায় ও সভা-সেমিনারে বক্তব্য দেওয়ার সময় বলা হয় ‘শিক্ষকের মর্যাদা সবার ওপরে’ অথচ বাস্তবে এর প্রতিফলন ততটা দেখা যায় না। দেশে শিক্ষার ভিত্তি স্থাপনকারী প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের পদমর্যাদা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষকদের মর্যাদা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে সেই তুলনায় অন্য পেশাজীবীদের আর্থসামাজিক মর্যাদা বেড়েছে শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে বেড়েছে পেশাগত বৈষম্য। ফলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এর মধ্যে আবার ভাবা হচ্ছে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’–এর নতুন পদ সৃষ্টির কথা। অথচ সমগ্র বাংলাদেশের গুটিকয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু হওয়া ছাড়া বাকি সব বিদ্যালয়েই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। সুতরাং দেশে এখনো প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই।
পাঠদান ছাড়া অন্যান্য অনেক কাজই শিক্ষকদের করতে হয়। আপাতদৃষ্টে হিসাবরক্ষক, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী নাকি সহকারী প্রধান শিক্ষক, কোন পদটি আগে সৃষ্টি করা প্রয়োজন, তা পুনরায় ভাবা যায়। শিক্ষকদের চাওয়া ও ভাবনা নিয়ে একটা জরিপ চালিয়েছিলাম। প্রায় দুই শ শিক্ষককে জরিপে ভোট দিতে অনুরোধ করেছিলাম। দেখেছিলাম অনাগ্রহ। বোঝাই যায় কারণ আর কিছুই নয়। তাঁরা দেখে আসছেন এত আন্দোলন, মানববন্ধন, মিছিল কিংবা লেখালেখি করে আসলে তেমন কিছুই হয় না। তাঁরা বঞ্চিতদের দলেই থেকে যান।
জরিপে ভোট দেন ২১ জন শিক্ষক। যাঁদের বয়স ২৪ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। প্রশ্ন রেখেছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য কোন পদটি সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ৫৭ শতাংশ বলছেন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর আর ১৫ শতাংশ বলছেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা কাম কম্পিউটার অপারেটর। ৩১ জানুয়ারি ২০১৭–এর সরকারি আদেশ অনুযায়ী সারা দেশে আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়। গত চার বছরে আরও কিছু বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়।
উপবৃত্তিসংক্রান্ত কাজ, পঞ্চম শ্রেণির ডি আর, থানা শিক্ষা অফিসের বিভিন্ন কাজে অফিসে যাওয়া–আসা ছাড়াও এরপর যুক্ত হয়েছে অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের কাজ। কম্পিউটারে দক্ষ লোক ছাড়া এসব কাজ করাটা বেশ দুরূহ ব্যাপার। তা ছাড়া সরকার যেখানে স্কুলের প্রতিটি শিক্ষার্থীর ডিজিটাল আইডি এমনকি প্রতিটি বিদ্যালয়কে ডিজিটাল করার কথা ভাবছে, সেখানে কম্পিউটার অপারেটর বা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ব্যতিরেকে এখন ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ পদ সৃষ্টি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা শিক্ষা বিভাগের কর্তারাই ভালো জানেন! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ২৮ বছর ধরে চাকরি করা তিনি সাফ বলে দিলেন এতে আর কিছু না বাড়লেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যই বাড়বে। এ চাকরিতে দুই–তিন বছর, অথবা বাদই দিলাম, পাঁচ বছর পরপরও যদি পদন্নোতি দেওয়ার সিস্টেম চালু হয়, তবে না হয় কর্তারা উক্ত পদ সৃষ্টির কথা ভাববেন!
আপাতত একজন কম্পিউটারে দক্ষ লোক প্রয়োজন প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য।
জরিপে আরও একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম—তরুণ ও মেধাবীদের এ পেশায় ধরে রাখতে হলে কোনটি সবার আগে হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন, যাতে ৮১ শতাংশ বলছেন প্রমোশন চালুকরণ এবং বাকি ১৯ শতাংশ বলছেন শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালু করার কথা। প্রমোশন না হওয়ায় এ চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে তরুণ ও মেধাবীরা বারবার ভাবছেন। প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়—এটা করে লাভ কী, ওটা করে লাভ কী? প্রমোশন তো আর হবে না!
জরিপের আরেকটা বিষয় দেশ ও জাতির জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়। মাত্র ৪৭ শতাংশ শিক্ষক বলছেন, শিক্ষকতা পেশা তাঁদের ভালো লাগে, অন্যদিকে ৩৪ শতাংশই বলছেন অন্য কোথাও চাকরি হয়নি তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। বাকিরা ভোট দিয়েছেন ‘ঘটনাচক্রে শিক্ষক’–এর দিকে। এটা দেশ ও জাতির বড় একটি ব্যর্থতা, যার দায়ভার সবাইকেই নিতে হবে। এ জন্য আপনি শিক্ষকদের যদি দোষারোপ করতে চান তো মাথায় রাখুন যে প্রত্যেকেই তাঁর কাজের স্বীকৃতি চান। মহান পেশার ট্যাগ লাগিয়ে তাঁদের বঞ্চিত করার আগে ভাবুন দিন শেষে এটাও একটা পেশা, যেটার ওপর ভিত্তি করে লাখো পরিবার বেঁচে আছে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদার সঙ্গে কাজের আন্তরিকতা ও উৎপাদনশীলতার যোগসূত্র বিদ্যমান। একজন কর্মজীবীকে যথাযথ ও সন্তোষজনক মর্যাদা না দিয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়ার আশা করা যায় না। আমাদের শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একরাশ হতাশা ও গ্লানি। এখন খুব কম মানুষ শিক্ষকতা পেশাকে পছন্দ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন, বেশির ভাগই বিকল্প সুযোগ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। শিক্ষকতা পেশায় সুযোগ-সুবিধা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম ও ক্ষেত্রবিশেষ হতাশাজনক। তা ছাড়া যথাযথ সামাজিক মর্যাদারও পার্থক্য রয়েছে। তাই বেশির ভাগই এখন ‘ঘটনাচক্রে শিক্ষক’!
বেতন এবং তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলক বেশি থাকায় বিসিএস, ব্যাংক খাতের বেশির ভাগ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা চাকরিপ্রার্থীদের তুমুল আগ্রহ। অথচ শিক্ষার্থীদের ভিত মজবুত করে তোলার জন্য মেধাবী, দক্ষ এবং যোগ্য শিক্ষক অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকতা একটা আর্ট। আর্টিস্ট হতে ধৈর্য লাগে। পাশাপাশি দক্ষতাও লাগে। একজন শিক্ষককে কখনো মা–বাবার, কখনো বন্ধু, অভিভাবক এমনকি কখনো একজন মনোবিদের ভূমিকা পালন করতে হয়। একজন মানুষের এতগুলো রোল একসঙ্কে প্লে করার কাজটি কিন্তু মোটেও সহজ নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থী মিডিয়াম হিসেবে বেছে নেন। তাঁদের টার্গেট থাকে এখানে যেহেতু সময় বেশি পাওয়া যায়, সেহেতু চাকরির পাশাপাশি পড়ে দ্রুতই অন্য কোথাও সুইচ করে ফেলবে। এ ভাবনা নিয়ে থাকলে শিক্ষার্থীদের কতটা ভালো শেখানো যায়, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
পুরোনো নিয়োগবিধি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক নিয়োগে যে শিক্ষাগত যোগ্যাতা চাওয়া হতো, তার সঙ্গে পদন্নোতি দেওয়ার ব্যাপারটা সাংঘর্ষিক। নিয়োগবিধি পরিবর্তন করে ২০২০ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক পাস হওয়ায় এবং যারা পুরোনো নিয়োগের তাদের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ সংযুক্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের চাকরি ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এখন শিক্ষকেরা স্বপ্ন দেখতেই পারেন যে ভবিষ্যতে হয়তো এ চাকরিতে পদোন্নতি চালু করা হবে।
কিন্তু বিপত্তিটা যেখানে বেঁধেছে, তা হলো শ্রেণিবৈষম্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় অনাগ্রহের অন্যতম কারণ শ্রেণিবৈষম্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। একটি দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা, এটি সত্যিই অবাক হওয়ার মতো।
লেখক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ জাফর ইকবাল স্যার তাঁর লেখায় প্রাথমিক শিক্ষকদের অবহেলা ও নিগ্রহের কথা অত্যন্ত মর্মদায়কভাবে উপস্থাপন করেছেন অনেকবার। তাঁর ভাষায়, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু যখন আমি শিক্ষক নিয়ে কথা বলতে চাই, তখনই সবার প্রথমে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে। দেশের মানুষ কি এখনো জানে যে এই দেশের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী?’
বর্তমান নিয়োগবিধি অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে আবেদনের জন্য স্নাতক পাস চাওয়া হয়েছে। অথচ পদ সেই তৃতীয় শ্রেণি! বিসিএসসহ যেকোনো প্রথম শ্রেণির চাকরিতে আবেদনের জন্য স্নাতক পাস চাওয়া হয়। এখানেও তাই করা হলো, অথচ ওগুলোর পদমর্যাদা প্রথম শ্রেণির হলে সমমানের সার্টিফিকেট দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদ এখনো কেন তৃতীয় শ্রেণি হিসেবে গণ্য হবে, তা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে। তা ছাড়া এতে কি শিক্ষকতা পেশাকে যথার্থ সম্মান জানানো হলো কি না, তা–ও চিন্তার উদ্রেক করে। অন্তত দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়া উচিত কি না, তা অতি শিগগির ভেবে দেখা প্রয়োজন। না হলে স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা তরুণ শিক্ষকদের হতাশা বাড়বে। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর।
দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের শিক্ষকসমাজের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো এবং শ্রেণিবৈষম্য দূর করা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের ভিত গড়ে ওঠে প্রাথমিক শিক্ষকের হাত ধরেই। প্রাথমিক শিক্ষার দাতা হলেন আমাদের শিক্ষকেরা। তাই তাঁদের মর্যাদা নিয়ে উদাসীনতা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।