ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, শিক্ষকতা এক মহান পেশা। দেখে আসছি, শিক্ষকদের বেশি সম্মান করছে সমাজ ও দেশের নাগরিকেরা। কিন্তু রাষ্ট্র কি শিক্ষকদের প্রকৃত সম্মান দিতে পারছে? সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের যেভাবে আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, এর তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কম। প্রত্যেক ছেলেমেয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষারম্ভ শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রাথমিকের শিক্ষকেরা বাস্তবে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে যে কাজ করেন, তার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তাঁরা মাস্টার্স ডিগ্রি করে কাজে যোগ দেন, বেতন পান ১৩ নম্বর গ্রেডে। প্রাথমিকের শিক্ষকেরা কোমলমতি শিশুদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু একই স্তরে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্যান্য পেশায় বেশি বেতন–ভাতা পেয়ে থাকেন। যেমন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পদে নিয়োগ যোগ্যতা এসএসসি (৩ থেকে ৪ বছর কৃষি ডিপ্লোমা) নিয়ে দশম গ্রেডে বেতন পান। ইউনিয়ন সচিব পদে নিয়োগ যোগ্যতা আগে ছিল এইচএসসি, বর্তমানে স্নাতক বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে দশম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ যোগ্যতা স্নাতক বা সমমান দিয়ে দশম গ্রেড বেতন দেওয়া হয়। তাহলে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কেন ১৩ নম্বর গ্রেডে বেতন পাবেন? মাধ্যমিকপর্যায়ের শিক্ষকেরা সমান যোগ্যতা নিয়ে দশম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। এতে বাস্তবে একধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। তাতে ওইসব শিক্ষক মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং তাঁদের এই বেতন দিয়ে সমাজে জীবন বা সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
শিক্ষকেরা যদি আর্থিকভাবে সচল না থাকেন, তাহলে তাঁরা শ্রেণিকক্ষে গিয়ে সম্পূর্ণ মেধা বা শক্তি দিয়ে পাঠদান করাতে পারেন কি? মনে হয়, তাঁরা অনেক কষ্টে রয়েছেন। তাই কষ্ট লাঘব করার সময় আসছে। সরকারপ্রধান শিক্ষাব্যবস্থায় যথেষ্ট কার্যকর পরিবর্তন নিয়ে আসছে এবং শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বিষয়ে একটু নজর দেওয়ার জন্য। আপনার মাধ্যমেই সম্ভব আমাদের শিক্ষকদের চাহিদা পূরণ। কারণ, আপনার বাবা, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন।
শিক্ষকদের শুধু সম্মান দিলেই হবে না, তাঁদের আর্থিক বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, শিক্ষার মান উন্নয়নের সঙ্গে আর্থিক বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন করতে না পারলে অর্থনৈতিক বা সামাজিক উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়নে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে গেলে পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা দিতে হবে। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় মানে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি বা সেবা দিতে বেশি আগ্রহী হবেন বলে মনে করি।
শিক্ষার্থীদের ভিত তৈরি হয় প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তাই ওখানে যদি ভিত তৈরিতে ঘাটতি থাকে, যার প্রভাব সারা জীবন শিক্ষার্থীদের বহন করতে হয়, যা কোনোভাবেই হওয়া কাম্য নয়। যেমন কোনো দালান বা ঘর কত দিন টেকসই হবে, ভিত কতটা মজবুত তার ওপর নির্ভর করে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাকে নতুন করে সাজানোর সময় এসেছে। আর এই ভিত শক্তিশালী করতে হলে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের বিকল্প নেই। তাই দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং তাঁদের উপযুক্ত বেতন স্কেল দিতে হবে। অন্যদের থেকে তাঁরা যেন কোনো বৈষম্যের শিকার না হন। বৈষম্য নিয়ে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা কঠিন। তাই কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে কোনো প্রকার দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি মেনে নেওয়া যায় না। সামনে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে এবং তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট তদারকি বাড়াতে হবে, যাতে কোনো মহল প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কোনো সুযোগ না পায়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয় ২৯ হাজার টাকা (আনন্দবাজার পত্রিকা)। আর সেখানে বাংলাদেশে দেওয়া হয় ১৬ হাজার ২৫০ টাকা। তাহলে আপনি মেধাবী শিক্ষক কীভাবে প্রাথমিক স্তরে পাবেন? আর শিক্ষার্থীরা কি ভালমানের শিক্ষক পাচ্ছে? তাই শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ২০১৯–এর খসড়া নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রার্থিতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে শুনেছি, যা এখন চূড়ান্ত হওয়ার পথে। অর্থাৎ শিক্ষকদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো বিষয়। সরকারি সব দপ্তরে এ সুবিধা চালু আছে। বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী শিক্ষকেরা অনেকেই প্রধান শিক্ষক, এটিও, পিটিআইয়ের ইনস্ট্রাক্টর ইত্যাদি পদগুলোতে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। এতে করে সবার মধ্যে পড়াশোনা নিয়ে আগ্রহ কাজ করত। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে বিভাগীয় প্রার্থিতার বিকল্প নেই। বিভাগীয় প্রার্থিতার সুযোগ না থাকলে সহকারী শিক্ষক পদটি একটা ব্লক পোস্টে পরিণত হয়ে যাবে, যা শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত না করে বরং তাঁদের মানসিক চাপে রাখবে। তাঁরা পড়াশোনার উৎসাহ হারাবেন এবং শিক্ষাদানে ঘাটতি থেকে যাবে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেখতে পাই, ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজার পরও শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছেন না কোনো শিক্ষক। শিক্ষকদের কেউ গল্পে মশগুল, কেউ অন্য সহকর্মীর চুল বেঁধে দিচ্ছেন, কেউবা তুলছেন উকুন। এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। কেন শিক্ষকেরা এ রকম করছেন? কেন শিক্ষকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছেন? কোনো অপূর্ণতা শিক্ষকদের মনে রয়েছে কি না—তা খুঁজে বের করা উচিত। অপূর্ণতা থাকলেও আপনি দায়িত্বে অবহেলা করতে পারেন না। কারণ, আপনি তো বর্তমান বেতন কাঠামো দেখে এই চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। নিজ ইচ্ছায় কেউ কোনো দায়িত্বে অবহেলা করলে তাঁকে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।
সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সহকারী শিক্ষক পদের বেতন স্কেলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে বেতন গ্রেডে পরিবর্তন আনা হলেও সব সহকারী শিক্ষক এই গ্রেডে বেতন–ভাতা পাবেন না। তাই শিক্ষকদের মাঝে নতুনভাবে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
মেধাবী শিক্ষক প্রাথমিক স্তরের নিয়োগ দিতে হলে শিক্ষকদের গ্রেড অন্য চাকরির সঙ্গে সামঞ্জস্য করা,পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। একজন সহকারী শিক্ষক যেন তার জীবনের একটি পর্যায়ে তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং সেখান থেকে আরও উঁচু পদে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। তবে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বেতনবৈষম্য দূর করা হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এটা বাস্তবায়ন হলে, তা হবে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
লেখক: সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ