প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশের উদ্ভাবনী শক্তির জন্য আশীর্বাদ, না অভিশাপ?

শিশুদের পড়াশোনা চলছে বাসায়
ফাইল ছবি

‘প্রতিযোগিতা’ শব্দটি আমাদের সবার জীবনের সঙ্গে জড়িত। শব্দটি শুনলেই স্মৃতির মানসপটে হয়তো ভাসে কোনো এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের দৃশ্য, হয়তো মনে হয় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের নিবিড় প্রয়াস। তবে বাস্তব হলেও সত্য, প্রতিযোগিতাকে একটি সমাজ কীভাবে গ্রহণ করে, তার ওপর ওই সমাজের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে।

ট্রেডিংইকোনমিকস ডটকমের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যায়, পৃথিবীর যেসব রাষ্ট্রকে আমরা ‘উন্নত’ বলে মানি, তাদের দেশে প্রতিযোগিতা হয় সবচেয়ে বেশি। যেমন এই র‍্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগী দেশগুলোর কয়েকটি হলো জাপান (স্কোর ৮২.৪৭), সুইজারল্যান্ড (৮২.৫৯) ও আরব আমিরাত (৭২.৩৭)। যদি অনুন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পারি এক বিপরীত চিত্র। উদাহরণস্বরূপ, জিম্বাবুয়ের স্কোর ৪৪.২৪ এবং ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রে স্কোর ৪১.৮৩।

স্কোরের এই বৈপরীত্য থেকে একটি বিষয় সহজেই অনুমেয়। যে দেশ যত উন্নত, সমাজের প্রতিটি শ্রেণির সেখানে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ তত বেশি। উন্নত দেশে সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তৈরি করার সুযোগ থাকে, ভালো আইডিয়া থাকলে তাদের ব্যবসা করার জন্য অর্থ পাওয়ার সুযোগ থাকে।

বিপরীতে এসব দেশের সফল প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারের ‘নতুন’ প্রতিযোগীদের আসার পথ অন্যায্যভাবে বন্ধ করে না। নতুন প্রতিযোগীদের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য তারা বিনিয়োগ করে গবেষণার পেছনে। যে প্রয়োজনীয়তার তাগিদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গড়ে ওঠে গবেষণার এক সাধু চর্চা। ফলে জ্ঞান–বিজ্ঞানে এগিয়ে যায় এসব দেশ, তৈরি হয় এক বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ। আর অনুন্নত দেশগুলোয় চলে প্রতিযোগিতাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার এক অসাধু প্রয়াস। এ সমাজে হয় না সম্পদের সুষম বণ্টন, বলতে গেলে থাকে না সমাজের নিচের স্তরের মানুষের ওপরে ওঠার রাস্তা। প্রথমটিকে বলা যেতে পারে সুস্থ প্রতিযোগিতা আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিকে বলে যেতে পারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

এখন প্রশ্ন থাকে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী অবস্থা? ট্রেডিংইকোনমিকস ডটকমের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ৫২.১২। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস রিপোর্টে (বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন) একই চিত্র দেখা যায়, যেখানে প্রতিযোগিতার সুস্থতার মাত্রায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১টি দেশের মধ্যে ১০৫তম। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা ও তার সঙ্গে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে বাংলাদেশ এখনো অনেক দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। অনেকগুলো সূচকের দিকে তাকালে আমরা তার প্রমাণ পাই। যেমন ইজ অব ডুইং বিজনেসের (ব্যবসা করার সহজতা) র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ১৯০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। অর্থাৎ ব্যবসা চালু করার ব্যাপারটি এ দেশের সবার জন্য সহজ নয়, যার চূড়ান্ত প্রতিফলন গিয়ে পড়ে গবেষণায়।

উদাহরণস্বরূপ, গেল ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৮ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে, সেখানে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৬৬ কোটি টাকা।

এখানে লক্ষণীয়, দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬৮তম এবং শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৮৪তম। কেবল নেপাল ও পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের পেছনে (যথাক্রমে ১০৮ ও ১১০)। সামগ্রিকভাবে, এ প্রতিটি দেশের অবস্থান এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির সূচকে এশিয়ার গড় সূচকের (৪.৩৯) থেকে কম (শ্রীলংকার ৩.৬৩, ভারতের ৩.০৬, পাকিস্তানের ২.৪৫ ও নেপালের ১.৫৮), বাংলাদেশের অবস্থান তার চেয়ে কম (মাত্র ১.৪৯)। আরও অবাক করার ব্যাপার হলো, গত ১০ বছরে পুরো পৃথিবীর মাত্র ৩.৯৪% জ্ঞান উৎপাদিত হয় দক্ষিণ এশিয়ায়। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৩.২%! যা এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম! কাজেই, অবাক হওয়ার অবকাশ থাকে না, যখন ২০২০ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচকে বাংলাদেশকে ১৩১ দেশের মধ্যে ১১৬তম অবস্থানে পাওয়া যায়।

সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাবে এ দেশের হাতেগোনা দেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নেই কোনো বিশেষায়িত গবেষণা ইউনিট। অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য উদ্ভাবন ও গবেষণার প্রয়োজন না থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নেই এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পৃষ্ঠপোষকতা। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্ণধারদের হাত ধরে তৈরি হতে পারত উদ্ভাবন করার এক জাতিগত সংস্কৃতি, যা দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো দেশে। বলা বাহুল্য, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনা করে এসব দেশের ধনী ব্যক্তিরা তাঁদের জীবদ্দশায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তাঁদের সম্পদের একাংশ লিখে দিয়ে যান। এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য সরকার তাঁদের বিভিন্ন ধরনের কর প্রদানের বিধিনিষেধে শিথিলতা প্রদান করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।

১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে প্রতিযোগীর অভাব নেই, তবে আছে সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাব, আছে প্রতিযোগীদের দেওয়া চ্যালেঞ্জকে নিজের সক্ষমতা দিয়ে মোকাবিলা করার মানসিকতার অভাব। অদূর ভবিষ্যতে মধ্যম আয়ের দেশে নিজেদের উন্নীত করা, ২০৩০ সালে পৃথিবীর ২৮তম বৃহৎ অর্থনীতির তকমাটি পাওয়ার পাশাপাশি দেশের সব স্তরে সুস্থ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করার জন্য শুধু দেশের প্রশাসন নয়, দেশের সব স্তরের মানুষ একসঙ্গে কাজ করবেন, এই আশা ব্যক্ত করি।

*লেখক: মো. আতিকুল বাসার, প্রভাষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়