বাংলাদেশের নেত্রকোনা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, ব্যাংকক থেকে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, আর অকল্যান্ড থেকে ওয়েলিংটন। বেশ লম্বা জার্নিই তো। কিন্তু সব ক্লান্তি মুছে গেল যখন অপরূপ সুন্দর, সাজানো-গোছানো ও পরিচ্ছন্ন ওয়েলিংটন শহরটাকে দেখলাম।
সময়টা ছিল ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস। বাংলাদেশ সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সারা দেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজে মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে। দেশের ৬৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অত্যাধুনিক আইসিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। আরও ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন তখন প্রক্রিয়াধীন ছিল (আমি যত দূর জানি, সব কটির বাস্তবায়ন ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে)। সব শিক্ষককে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এরই অংশ হিসেবে আমাদের ২৬ জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানের একটা দলকে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে পাঠানো হয়েছিল। টিম লিডার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সারোয়ার হোসেন ছিলেন একজন যোগ্য, ধৈর্যশীল ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তি।
যাহোক, প্রশিক্ষণের সময় অসাধারণ এ দেশটা, যেটাকে আমার উন্নয়নের দিক থেকে বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মানের দিক থেকে আমেরিকার কাছাকাছি মনে হচ্ছিল। ২০১০ সালে আমেরিকায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় যেমন সর্বাঙ্গসুন্দর ও সাজানো–গোছানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখেছিলাম, নিউজিল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থাও অনেকটা তেমনই দেখেছি। এগুলো দেখে আমার কেবলই মনে হয়েছে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর দেশের সার্বিক পরিবেশটা কখন নিউজিল্যান্ডের মতো হবে।
আমি আগেই বলেছি, নিউজিল্যান্ড এক অনিন্দ্যসুন্দর দেশ, যা দেখে অভিভূত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের লোকদের জন্য এটাই স্বাভাবিক। আমরা এ দেশের মতো দেশগুলোয় এসে অভিভূত হয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে ফেসবুকে দিই। আর এসব দেশের বিভিন্ন দিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়ি। ভালোকে ভালো বলার মধ্যে অবশ্য দোষের কিছু নেই। বরং ভালো কিছুর প্রশংসা করাই উচিত। কিন্তু বিষয়টি এর মধ্যে শেষ না হয়ে প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ভুলে গেলেই সর্বনাশ। কারণ, তখন মূল বিষয়টি প্রশিক্ষণ না থেকে সেটি নিছক ভ্রমণে পরিণত হয়ে যায়।
একটা কথা ভালো করে ভেবে দেখা দরকার যে সরকার জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমাদের দেশে ও দেশের বাইরের উন্নত দেশগুলোয় প্রশিক্ষণ নিতে পাঠায়। উন্নত দেশে পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো এসব দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার হয়, তা দেখে ও শিখে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করার জোর প্রচেষ্টা চালানো। তা না হলে এত টাকা খরচ করে এসব দেশে আসার কোনো অর্থ থাকবে না। আর আইসিটিসংক্রান্ত যেসব যন্ত্রপাতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়েছে, দিনের পর দিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকলে একপর্যায়ে এগুলো এমনিতেই অকেজো হয়ে যায়।
একটা কথা মনে রাখতে হবে যে নিউজিল্যান্ডের আজকের অবস্থায় আসা কিন্তু এক দিনে সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় পৌঁছাতে অবশ্যই তাদের বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর পরিশ্রম করতে হয়েছে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে যে নিউজিল্যান্ডের আজকের অবস্থায় আসা কিন্তু এক দিনে সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় পৌঁছাতে অবশ্যই তাদের বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর পরিশ্রম করতে হয়েছে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ না করলে কোনো দেশের পক্ষেই এভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। আজকের নিউজিল্যান্ড শুধু যে তার শহরগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়েছে তাই না বরং, তার প্রাকৃতিক পরিবেশটা আর বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যে অপূর্বভাবে সাজিয়েছে, যা নিজের চোখে না দেখলে কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না।
এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি শুধু দেশটাকে মুখে মুখে ভালোবাসব, নাকি উন্নত দেশের লোকদের মতো কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের দেশটাকে তাঁদের দেশের মতো করে গড়ে তুলব? উত্তরটা খুব সোজা হওয়া উচিত। আর সেটা হলো অতি অবশ্যই আমরা আমাদের দেশটাকে উন্নত বিশ্বের দেশ হিসেবে দেখতে চাই। এ ক্ষেত্রে আমাদের আশার কথা হলো আমরাও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছি। আমাদেরও আছে ভিশন–২১ ও ভিশন–৪১। ভিশন দুটি ঠিক করেছেন আমাদের মহান নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। আর এর ফলও পাচ্ছি আমরা হাতে হাতেই।
এমডিজি আমাদের অর্জিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। এসডিজি অর্জনের জন্য এখন সবার দরকার কোমর বেঁধে কাজে লাগার। অবশ্য নিউজিল্যান্ড তার উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি প্রাকৃতিক সুবিধা পেয়েছে। নিউজিল্যান্ডের আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের দেড় গুণ হলেও জনসংখ্যা মাত্র ৪৮ লাখের মতো। দেশে পাহাড়ি অঞ্চলের আধিক্য থাকায় বনাঞ্চলের পরিমাণও অনেক বেশি। ফলে এ দেশে বায়ুদূষণ নেই বললেই চলে। এ দেশের কাঠ বিশ্ববাজারে খুব মূল্যবান। নিউজিল্যান্ডকে ঘিরে যে বিশাল সমুদ্রাঞ্চল রয়েছে তা যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেশটাকে পর্যটনক্ষেত্রে পরিণত করেছে, তেমনি এর জলরাশি খুব পরিষ্কার থাকায় বিশ্ববাজারে এ দেশের মাছের চাহিদা ও দাম দুটোই খুব বেশি। নিউজিল্যান্ডের দুধ আর মধু সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। আর এই সব কটিই দেশটির সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদের আধিক্য না থাকলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আমাদেরও আছে। নিউজিল্যান্ডের যেমন আছে বিখ্যাত স্যামন মাছ, আমাদেরও আছে তেমন পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু ইলিশ মাছ।
আছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক গ্যাস। আছে বিশাল বঙ্গোপসাগরসহ অসংখ্য নদ–নদী, হাওর–বাঁওড়, খাল–বিল ইত্যাদি প্রাকৃতিক মৎস্যভান্ডার, যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি এখন সুনীল অর্থনীতি হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। আছে বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর জমি, খাদ্য নিরাপত্তায় যার ভূমিকা তুলনাহীন। সর্বোপরি আমাদের আছে পৃথিবীর সবচেয়ে কর্মঠ ও ধৈর্যশীল কৃষক সমাজ, যাঁরা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সক্ষম। সমস্যার কথা বিবেচনা করলে নিউজিল্যান্ডের তুলনায় আমরা অনেক অসুবিধায় আছি। আয়তনের দিক থেকে ছোট একটা দেশের বইতে হচ্ছে বিশাল এক জনসংখ্যা বোঝা। সম্পদের অপ্রতুলতার পাশাপাশি আছে ঐকমত্যের অভাব। আছে ধর্মীয় হুজুগ বা উন্মাদনা। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো জুটেছে রোহিঙ্গা সমস্যা। আছে ভারতের মতো বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন নদীর পানির বণ্টনসহ আরও কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা।
বন্যা, খরা আর নদীভাঙন তো আমাদের দেশের নিত্যসঙ্গী। আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সমস্যার বিরূপ প্রভাব। সর্বোপরি আছে বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভয়াল থাবা। সমস্যার হিসাব দেওয়া যাবে এমন আরও অনেক।
কিন্তু বাংলাদেশও বসে নেই। সব প্রতিকূলতার চোখরাঙানো উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছে দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অপরিসীম সাহস আর ধৈর্য আর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলে আমরা উৎক্ষেপণ করতে পেরেছি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বাস্তবায়িত হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো উচ্চবিলাসী মেগা প্রকল্প। বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যেও বিশ্বকে অবাক করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। অবকাঠামোগত ও ডিজিটাল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এখন আমার কথা হলো আমরা যাঁরা জনগণের টাকায় নিউজিল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলাম, দেশের অগ্রযাত্রায় সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা কতটুকু। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যাদের শিক্ষাদান করছি, একটা সময় তারাই কিন্তু দেশের হাল ধরবে। তাদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের কৌশলটা কী হবে?
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। প্রশিক্ষণের প্রথম দিনের প্রথম সেশনে প্রশিক্ষক মহোদয় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আজকের সেশনে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে যিনি ভালো পারফর্ম করবেন, তাঁকে একটা পুরস্কার দেব।’ যাহোক, সেশনের একপর্যায়ে উনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকের কী করা উচিত?’বিভিন্নজন বিভিন্ন উত্তর দিচ্ছিলেন। আমি তখন বললাম, একজন শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করা আর তার মনের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বোনা। কারণ, স্বপ্নই মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রশিক্ষক মহোদয় আমার কথাটা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই পুরস্কারটা গ্রহণ করতে আমাকে আহ্বান করলেন।পুরস্কারটি ছিল অতি সাধারণ একটা ললিপপ। কিন্তু তাতেই আমার মনটা ভরে গিয়েছিল। খুব ভালো লেগেছিল সেদিন। সত্যিই তো, জোর করে কাউকে কিছু শেখানো সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিকারের অনুপ্রেরণা পেলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে যে মানসিক শক্তিটা পায়, তাতে সে নিজের কাজটা নিজেই করে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আর এটা তাঁর প্রাণশক্তিকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। আমেরিকা আর নিউজিল্যান্ড—এই দুই জায়গাতেই আমি এ বিষয়টা লক্ষ করেছি। সেখানকার শিক্ষকেরা সর্বোচ্চ ধৈর্য আর মমতা দিয়ে চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা আর মননশীলতাকে জাগিয়ে তুলতে। পাঠদানের ক্ষেত্রে তাঁরা যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পান, আমাদের তেমন সুযোগ নেই, এটা ঠিক। কিন্তু যেটুকু আছে, সেটুকু নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চ চেষ্টা তো করে দেখতে পারি। আমরা কি পারি না আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে? আমরাও তো স্বপ্ন দেখছি উন্নত বিশ্বের এলিট ক্লাবের সদস্য হওয়ার। তাই অন্তত আমাদের সন্তানদের সুন্দর আগামীর কথা ভেবে এটুকু তো আমাদের করাই উচিত।
*লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা