বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অগ্রণী ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করেছিল। শুধু অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে মানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলোকিত নাগরিকও তৈরি করে। এভাবে সমাজের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৯২ সালে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অধীনে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা দান করে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সূত্র অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৪৯টি সরকারি (সূত্র: http://www.ugc-universities.gov.bd/) এবং ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (সূত্র: http://www.ugc-universities.gov.bd/private-universities)। নিম্নের ‘ক’ এবং ‘খ’ চিত্রে বাংলদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিগত বছরের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, নীতিনির্ধারকেরা বেসরকারি শিক্ষা খাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই গুরুত্বের প্রতিফলনও ‘গ’ চিত্রে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ভর্তিকৃত ছাত্রছাত্রীর তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে (জুলাই-ডিসেম্বর) পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। নিজ নিজ বিভাগের শিক্ষকদের মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন করে আগ্রহী এই প্রোগ্রামে ভর্তির আবেদন করতে পারবেন। পিএইচডিতে ভর্তির আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা হচ্ছে—
১.
ভর্তির জন্য প্রার্থীকে এমফিল পাস অথবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছর মেয়াদি স্নাতক সম্মান ও এক বছর মেয়াদি মাস্টার্স ডিগ্রি অথবা তিন বছর মেয়াদি স্নাতক সম্মান ও এক বছর মেয়াদি মাস্টার্স ডিগ্রি থাকতে হবে।
২.
প্রার্থীদের সব পরীক্ষায় কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণিসহ ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নম্বর থাকতে হবে। সিজিপিএ নিয়মে মাধ্যমিক/সমমান থেকে স্নাতক/স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব পরীক্ষায় সিজিপিএ–৫-এর মধ্যে ৩.৫ অথবা সিজিপিএ– ৪-এর মধ্যে ৩ থাকতে হবে।
৩.
তিন বছর মেয়াদি স্নাতক সম্মান ও এক বছর মেয়াদি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনকারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে স্নাতক পর্যায়ে কোনো স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে দুই বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা কোনো স্বীকৃত মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে দুই বছরের গবেষণাসংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে দুই বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
৪.
প্রার্থীদের স্বীকৃত মানের জার্নালে প্রকাশিত কমপক্ষে দুটি গবেষণা প্রবন্ধ থাকতে হবে। কলা অনুষদ, সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদ ও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ক্ষেত্রে অন্তত একটি গবেষণা প্রকাশনা একক নামে হতে হবে।
এই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দেশের কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রোগ্রামে সরাসরি ভর্তি হতে পারবেন না। পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির আগে তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল প্রোগ্রামে ভর্তি হতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রিধারীদের আবেদনপত্র সংগ্রহের আগে অর্জিত ডিগ্রির সমতা নিরূপণের জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে দরখাস্ত করতে হবে।
একটি নির্দিষ্ট ডিগ্রি প্রোগ্রামে দেশের প্রচলিত শিক্ষা আইন অনুযায়ী একই ধরনের কোর্স কারিকুলাম কিংবা একই প্রতিষ্ঠান ইউজিসির অধীনে অনুমোদিত প্রোগ্রাম থেকে পাস করা একজন ছাত্র একই ধরনের একাডেমিক রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও শুধু তার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের কারণে পিএইচডি ভর্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে, তা বৈষম্য বৈ আর কিছু নয়। মনে রাখা দরকার, বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি নামে কোনো আলাদা নীতিমালা রাখেনি। আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়া কিংবা ইরানের রাজনৈতিক দূরুত্ব থাকলেও আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাশিয়া কিংবা ইরানের নাগরিকদের মেধার মূল্যায়ন করে পিএইচডিতে ভর্তি নেয়। সেখানে নেই কোনো আলাদা নীতিমালা। আর এতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে বৈ কমছে না। আমাদের দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটরাও এখন অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।
দেশের প্রচলিত আইন মেনে স্বায়ত্তশাসিত একাডেমিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো নিজেদের একাডেমিক নীতি প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ কিংবা জনগণের করের টাকায় পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক নীতিমালা নৈতিকভাবে প্রণয়ন করতে পারে কি না, তা নিয়ে আলোচনার যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে।
১৯৯২ সালের পর থেকে এ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রসারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদিও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন কিংবা নেতিবাচক খবর প্রায়ই প্রত্রিকায় দেখা যায়। সেই বিষয়ে ইউজিসি মাঝেমধ্যে পদক্ষেপ নিলেও তার বাস্তবায়নজনিত পদক্ষেপ খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে এ ক্ষেত্রে ইউজিসি আরও সক্রিয় হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
বেশ কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ভর্তি বিজ্ঞপ্তি নিয়ে একই ধরনের ভাষা ও নীতি অনুসরণ করে আসছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্ত দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে যেমনিভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির নিয়োগপ্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করতে পারে। সর্বোপরি, বঞ্চিত এই শিক্ষার্থীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক অবজ্ঞার শিকার হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারেন, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনা থাকলেও এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমনিভাবে মানবসম্পদ তৈরি করছে, তেমনিভাবে শিক্ষার আলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে পুরো জাতি আলোকিত হচ্ছে। মানুষের সচতেনতা বৃদ্ধির কিংবা সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের পাশাপাশি মানুষের নিজেদের সিদ্বান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি গণমানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। আমরা আশা করব, পিএইচডি ভর্তির ক্ষেত্রে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে নীতিনির্ধারকেরা ভর্তি–ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেবেন। আর এই প্রক্রিয়ায় যোগ্যতম প্রার্থী নির্বাচিত হবে, যাঁদের সবাই রাষ্ট্র তথা মানবতার কল্যাণেই কাজ করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
লেখক: ড. মুহাম্মদ আবদুর রহমান ফরহাদ, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর