ভিনদেশে পড়তে যেতে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘রেফারেন্স লেটার’ বা সুপারিশপত্র জমা দিতে হয়। বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। রেফারেন্স লেটার নিয়ে অনেকের মনেই বহু প্রশ্ন—কে হবেন রেফারি (আপনি যাঁর রেফারেন্স দেবেন বা যিনি আপনার নাম সুপারিশ করবেন), কী লেখা থাকবে রেফারেন্স লেটারে, ধরনটা কী রকম হবে ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে তাই পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল অস্ট্রেলিয়ার গবেষক বিপাশা মতিন
আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অফিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা (সুপারভাইজার), কিংবা আপনার সঙ্গে কোনো প্রকল্পে কাজ করেছেন—এমন যে কেউই রেফারি হতে পারেন। সাধারণত দুটি রেফারেন্স লেটার লাগে, কখনো কখনো তিনটিও চাওয়া হয়। যদি কাজের অভিজ্ঞতা আপনার থাকে, তাহলে একজন শিক্ষক ও আপনি যাঁর সঙ্গে কাজ করছেন, অর্থাৎ আপনার নিয়োগকর্তা হতে পারেন আপনার রেফারি। তবে কর্মক্ষেত্রে যদি আপনার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে শিক্ষকদের মধ্য থেকেই দুজন আপনার রেফারি হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক আপনার গবেষণা/শিক্ষানবিশি (ইন্টার্নশিপ) /থিসিস সুপারভাইজার হলে ভালো হয়। ফ্যাকাল্টির ডিন বা বিভাগীয় চেয়ারম্যানও কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ।
তবে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ—তাঁদের ব্যস্ততা ও আপনার কাজ সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান। খুব বেশি ব্যস্ত ও সময় দিতে পারবেন না—এমন কাউকে রেফারি হিসেবে নির্বাচন না করাই উচিত। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক সময় ই-মেইল করে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী সম্পর্কে রেফারির কাছে জানতে চায়। রেফারির যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ই-মেইলের জবাব না দেন, তাহলে কিন্তু আবেদন বাতিল বলে গণ্য হবে। তাই আপনার রেফারি কতটা ব্যস্ত, ই-মেইলে তিনি কতটা সক্রিয়, তা মাথায় রাখুন। খুব বড় পদের কারও ব্যস্ততার কথা না ভেবে তাঁকে রেফারি করতে গিয়ে বিপদে পড়বেন না। এর চেয়ে তুলনামূলক ছোট পদের কিংবা কম ব্যস্ত কাউকে রেফারি করে আবেদন সঠিকভাবে জমা দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যেহেতু রেফারেন্সের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনাকে যাঁরা চেনেন ও জানেন, তাঁদের কাছ থেকে আপনার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা; তাই এমন কাউকে রেফারি হিসেবে নির্বাচন করবেন না, যিনি আপনার কাজ সম্পর্কে জানেন না। রেফারি যদি অবগত না-ও থাকেন, তবে আপনিই তাঁকে জানিয়ে দিন—আপনি কী কী বিষয়ে কাজ করেছেন বা কোন কোন কাজে আপনার আগ্রহ আছে।
রেফারেন্স লেটারে আপনার ভালো-খারাপ দুটো দিকই থাকবে। শুধুই ভালো কথা কিংবা প্রশংসা করে লেখা রেফারেন্স সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। তাই ভালো দিকগুলোর পাশাপাশি আপনার সীমাবদ্ধতার দু–একটি জায়গাও উল্লেখ থাকা উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে একটি কৌশল অবলম্বন করা যায়। কখনো কখনো খারাপ দিকের মধ্যেও একটা ভালো দিক লুকিয়ে থাকে। যেমন ধরুন, রেফারি লিখলেন: ‘ওর সবই ভালো, কিন্তু কাজের বেলায় ও খুব খুঁতখুঁতে। তাই কাজ শেষ হতে দেরি হয়,’ কিংবা ‘ও জয়ের নেশায় এতই মশগুল যে পরাজয় মানতে পারে না’—এ ধরনের বাক্যে কিন্তু আদতে আপনার প্রশংসাই করা হচ্ছে!
পুরো রেফারেন্স লেটারের চারটি অংশ থাকবে। প্রথম অংশ হলো রেফারি আপনাকে কীভাবে চেনেন? তিনি যদি আপনার শিক্ষক হন, তাহলে যোগ হতে পারে কেন আপনার কথা তাঁর মনে আছে, এত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আপনি আলাদা কেন? তিনি আপনাকে কত দিন ধরে চেনেন? এ রকম কিছু দিয়ে শুরু করার পর আপনার ভালো দিকগুলো স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এখানে আপনার দক্ষতার দিকগুলো ছাড়াও অন্যান্য সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের কথা উল্লেখ থাকতে পারে। রিসার্চ কোর্সে আবেদন করলে অবশ্যই এই অংশে আপনার গবেষণা নিয়ে দু–একটা বাক্য থাকা দরকার। পরের অংশে আপনার দু–একটি দুর্বলতার জায়গা (ইতিবাচকভাবে) উল্লেখ করা যেতে পারে। আর সবশেষে তিনি জোরালোভাবে উল্লিখিত পদ/বিষয়/প্রোগ্রামের জন্য আপনার নাম সুপারিশ করবেন।
লেখাটি তাঁর নামসংবলিত লেখার প্যাডে, স্বাক্ষরিত ও সিলসমেত থাকতে হবে।
একটা খুব কমন প্রশ্ন হলো—কোন ফরম্যাটে রেফারেন্স লেটার জমা দেব? বা মাধ্যমটা কী হবে? বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা স্কলারশিপ কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর। তারা কখনো কখনো আপনার কাছেই রেফারেন্স লেটার চাইবে, যা আপনাকেই নির্ধারিত নিয়মে আপলোড করতে হবে। সে ক্ষেত্রে লেটারটি আপনি আগে থেকেই স্বাক্ষরসহ স্ক্যান করে রাখবেন এবং পরে আবেদনের সময় আপলোড করবেন।
তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কলারশিপ কমিটি নিজেরাই আপনার রেফারির সঙ্গে যোগাযোগ করে রেফারেন্স লেটার চেয়ে নেবে। এ ক্ষেত্রে আপনি আবেদনের সময় শুধু রেফারির নাম, পদবি, ই–মেইল ও ফোন নম্বর উল্লেখ করবেন।
মুশকিল হলো বিশ্ববিদ্যালয় বা বৃত্তি কর্তৃপক্ষের ‘সিলেকশন কমিটি’ রেফারির কাছ থেকে সাড়া পেয়েছে কি না, তা কখনো কখনো আপনাকে জানানো হবে, আবার না-ও জানানো হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনারই উচিত হবে রেফারিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং অনেকটা লেগে থেকেই রেফারেন্স লেটার আপলোড করানো! মনে রাখবেন, রেফারি উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আপনার আবেদন কিন্তু সম্পূর্ণ হবে না। তাই নিজ গরজে রেফারির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। আপনার নাম, পরিচয়, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কোন বৃত্তির জন্য কোন বিষয়/প্রোগ্রামে আপনি আবেদন করেছেন, এসব সম্পর্কে তাঁকে অবগত রাখুন। অনলাইনে আবেদন করলে আপনি অবশ্য রেফারেন্সের’ স্ট্যাটাস’ দেখতে পাবেন। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে আশা করি সমস্যা হবে না। সময় শেষ হয়ে যাওয়ার অন্তত তিন–চার দিন আগে রেফারিকে আবার মনে করিয়ে দিন। তিনি যদি বিরক্ত হন, সেটিও সামাল দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। ঠিকঠাকভাবে কথা বলতে পারা বা নিজের চাহিদা উপস্থাপন করতে পারাও একটি দক্ষতা। বৃত্তি পেতে হলে বা ভিনদেশে পড়তে হলে এই দক্ষতা তো আপনার থাকতেই হবে।
বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে, বেশির ভাগ রেফারিই হয়তো আপনাকে বলবেন, ‘একটা ড্রাফট (খসড়া) করে আনো।’ এটি একদিক থেকে যেমন আপনার জন্য সুযোগ, অন্যদিকে বিপদও বটে। সুযোগ, কারণ আপনি জানেন আপনার কোন বিষয়গুলো রেফারেন্সে আসা উচিত, তাই নিজেই উল্লেখ করে দিতে পারেন। আর বিপদ হলো, খসড়া তৈরি করতে গিয়ে নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত প্রশংসা করা হয়ে যেতে পারে! তাই কতটুকু প্রশংসা করবেন বা করবেন না, তা নিয়ে আপনি দ্বিধায় ভুগতে পারেন।
খসড়া লেখার ক্ষেত্রে ২ নম্বর পয়েন্টে যা আলোচনা করেছি, তা মাথায় রাখবেন। ব্যাকরণ ও বানানের দিকগুলো বারবার দেখবেন, যেন কোনো ভুল না থাকে। রেফারেন্স লেটারের খসড়া তৈরি করতে গিয়ে কখনোই গুগল থেকে সরাসরি ‘কপি-পেস্ট’ করতে যাবেন না। অতিরঞ্জিত প্রশংসা কিংবা সমালোচনা, কোনোটাই করা যাবে না। আবার তাই বলে গতানুগতিক, একঘেয়ে ধরনের লেখাও কার্যকর হবে না। আপনার দক্ষতাগুলোকে গল্পের মতো করে উপস্থাপনের চেষ্টা করুন।
১. রেফারির ই–মেইল আইডি অবশ্যই ‘অফিশিয়াল’ হতে হবে। জিমেইল কিংবা ইয়াহু ছাড়া যদি আর কোনো ই–মেইল আইডি না থাকে, তবে তাঁকে রেফারি না রাখাটাই সমীচীন।
২. কাজ হয়ে গেলে রেফারিকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেন না।
৩. নিজের একটি সিভি রেফারিকে দিয়ে রাখতে পারেন, যেন লেখার সময় তিনি আপনার সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।
৪. আপনি হয়তো একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করছেন। একজন রেফারিকে বারবার বিরক্ত না করে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে একাধিক রেফারির নাম উল্লেখ করতে পারেন।
৫. কখনো কখনো শিক্ষকদের ‘টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট’রা এ ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখেন। শিক্ষককে বারবার বিরক্ত না করে আপনি টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন।