গত দুই দশকে সারা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের প্রভাব সমানতালে পড়েছে গেমস তৈরির শিল্পেও। এমনকি বিনোদনের জগতে শিল্প হিসেবে আয়ের ক্ষেত্রে গেমস আছে শীর্ষে! ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ভিডিও গেমস শিল্প ছিল ১৩ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের শেষে ১৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
এই বিশাল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন বিভিন্ন বিষয়ের পেশাজীবীরা। কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ডিজাইনার, লেভেল ডিজাইনার, গেম প্রডিউসার, গেম আর্টিস্ট, গেম টেস্টার আরও কত কী! শুধু গেম বানানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই শিল্পে পেশা গড়েছেন, তা নয়; তালিকায় আছেন যাঁরা গেম খেলেন তাঁরাও, অর্থাৎ গেমাররা। প্রতিযোগিতামূলক গেমসে যুক্ত থেকে পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে আয় করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া ইউটিউব কিংবা টুইচের মতো ভিডিও দেখার ওয়েবসাইট রাখছে বড় ভূমিকা।
বাংলাদেশেও গেমারদের একটা বড় ‘কমিউনিটি’ গড়ে উঠেছে। এর পেছনে তাদের ফেসবুক গ্রুপগুলোর বেশ অবদান আছে। কিছু দল গড়ে উঠেছে সব ধরনের গেমারের মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্য। কিছু গ্রুপ নির্দিষ্ট গেমভিত্তিক, কিছু আবার যন্ত্রনির্ভর। এই গ্রুপগুলোতে সব সময়ই আলোচনা চলে। গ্রুপের মাধ্যমে আয়োজিত হয় প্রতিযোগিতাও।
শুধু ভ্যালোরেন্ট গেম খেলে এমন গেমারদের জন্য গড়ে ওঠা গ্রুপ ‘ভ্যালোরেন্ট বাংলাদেশ কমিউনিটি অফিশিয়াল’। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য জহিরুল ইসলাম বলেন, ভ্যালোরেন্ট বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় গেমগুলোর একটি। প্রতিযোগিতার তথ্য কিংবা এই গেম–সংক্রান্ত বিভিন্ন সহযোগিতা গ্রুপে মানুষ বিশেষভাবে পায়, যেটা সাধারণ গ্রুপগুলোতে খুব একটা পাওয়া যায় না।
গেমারদের জন্য বাংলাদেশে বিশেষভাবে গড়ে ওঠা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘রেঞ্জ’। গেমারদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করেন এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সাদমান সাকিব। তিনি বলেন, ‘এই প্ল্যাটফর্মের সব ফিচার এখনো উন্মুক্ত করা না হলেও আমরা এরই মধ্যে কিছু গেমস প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি। সব বৈশিষ্ট্য উন্মুক্ত হলে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গেমাররা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে কমিউনিটিটাকে আরও বড় করতে পারবেন; বিভিন্ন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করতে পারবেন।’
একটি অথবা কয়েকটি গেমকে কেন্দ্র করে গেমাররা গড়ে তোলেন একেকটি ‘ক্ল্যান’। অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার গেমারদের নিয়োগও দিয়ে থাকে। তাঁরা মাসিক বেতনও পান। আর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়ে গেমাররা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
বাংলাদেশে নিয়মিতই বিভিন্ন গেমস প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে। বর্তমানে বেশির ভাগ আয়োজনই হচ্ছে অনলাইনে। এ বছর গ্লোবাল ই-স্পোর্টস নেটওয়ার্ক ইএসপিএলের সঙ্গে যুক্ত ‘ইএসপিএল বাংলাদেশ’ একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সিরিজ এই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ আয়োজন হয়েছে গত এপ্রিলে।
‘আমি মনে করি, একেকটা সফল আয়োজন পুরো গেমিং কমিউনিটিকে প্রভাবিত করে। যত বেশি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে, গেমাররা তত বেশি নিজেদের ঝালাই করার সুযোগ পাবেন; সুযোগ পাবেন কমিউনিটির অন্য মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার,’ বলছিলেন ওলফ্রেমাইট ই–স্পোর্টসের সহপ্রতিষ্ঠাতা কাভি শাহ। প্রতিষ্ঠানটি ‘ওলফ্রেমাইট ভ্যালোরেন্ট কমিউনিটি কাপ’ শিরোনামে গত বছর একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেখানে ৩২টি দল অংশ নিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন গেমস টুর্নামেন্টেও বিভিন্ন সময়ে অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন দল। তবে গেমারদের সঙ্গে আলোচনায় আমরা জানতে পারি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্য এখনো খুব বেশি নয়। ‘মার্সেনারিজ’ নামে একটি বাংলাদেশি দল দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ‘রেইনবো সিক্স সিজ ২০২০ নভেম্বর মেজর’ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ থেকে মোট আটটি দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত হয় এই প্রতিযোগিতা।
কথা হলো টিম মার্সেনারিজের দলপতি হাসিবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একটি দলের সাফল্যের পেছনে প্লেয়ারদের পাশাপাশি কোচ, অ্যানালিস্টদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা পেলেই এসব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও ই-স্পোর্টস খাতে তাদের সরকার বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দেয়, যা আমাদের জন্য একরকম স্বপ্নের মতো। এ ছাড়া স্পনসরের অভাব তো আছেই। আমি মনে করি, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে আমাদের ই-স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রির একটা শক্ত কাঠামো তৈরি হবে। আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও শক্ত অবস্থান গড়তে পারব।’
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রথম বাংলাদেশি কম্পিউটার গেম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জিরো আওয়ার। আত্রিতো এবং এম সেভেন স্টুডিওজের কয়েকজন তরুণ তৈরি করেছেন এই ফার্স্ট পারসন শুটার গেমটি। গেমের চরিত্রের মডেল, আর্কিটেকচারাল মডেল, টেক্সচার, থ্রিডি মডেলিং, মোশন গ্রাফিকসসহ সব নিজেরাই করেছে জিরো আওয়ারের দল। গেমটি মূলত প্রকাশিত হয়েছে বেটা সংস্করণ হিসেবে। গেমারদের কমিউনিটি থেকে প্রতিক্রিয়া নিয়ে এটি হালনাগাদ করা হচ্ছে নিয়মিতই। পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশের কথা থাকলেও আরও বেশি কিছু দেওয়ার আশায় কাজ করছেন নির্মাতারা।
আত্রিতো লিমিটেডের চেয়ারম্যান নাঈম বিন হাসান বলেন, ‘বিদেশের বিভিন্ন গেমের পেছনে কিন্তু অনেক বড় দল কাজ করে। বড় বিনিয়োগ ও বিপণন থাকে। আমাদের তা না থাকা সত্ত্বেও খুব অল্প সময়েই আমরা বিশ্বব্যাপী সাড়া পেয়েছি। গেমারদের থেকে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াও পাচ্ছি নিয়মিত। আমরা সেসব প্রতিক্রিয়াকে আমলে নিয়ে গেমটাকে একটা ভালো অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করছি। সব ঠিকঠাক হলে এর পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশ করতে চাই শিগগির।’