কিছুদিন আগে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঘোষণাটা দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। তাঁদের শিক্ষার্থীদের জন্য শিগগিরই ‘অন ক্যাম্পাস জব’ চালু করা হবে। অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও বেশি অবদান রাখতে পারে, সে জন্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস, রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন ল্যাব আছে। শিক্ষার্থীদের যেন টিউশনি করে সময় নষ্ট না করতে হয়, সে জন্য অন ক্যাম্পাস জব চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
অন ক্যাম্পাস জব হলো একধরনের খণ্ডকালীন চাকরি, যার মাধ্যমে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসেই কাজ করার সুযোগ পান। এতে একদিকে শিক্ষার্থীদের যেমন অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হয়, অন্যদিকে তাঁরা বাড়তি আয়েরও সুযোগ পান।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন ক্যাম্পাস জবের সুযোগ আছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, স্টুডেন্ট টিউটরসহ হালের কনটেন্ট ক্রিয়েটর, গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। এসব কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে মাসিক কিংবা ঘণ্টাভিত্তিক বেতন দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কাজ করেন, এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী শুনিয়েছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে বন্ধুরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত, সুমায়ার তখন অফিস শুরু। সুমায়া ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছেন, দশম সেমিস্টারে। তাঁর আরেক পরিচয়—‘স্টুডেন্ট টিউটর’। ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক মাহরীন মামুনের সঙ্গে কাজ করেন সুমায়া। বিভাগের শিক্ষকদের আলোচনা সভার গুরুত্বপূর্ণ অংশের নোট নেওয়া, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পরিদর্শক হিসেবে কাজ করা, ফলাফল প্রস্তুত করা তাঁর নিয়মিত কাজের অংশ। এ ছাড়া ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের স্নাতক শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বিষয়ে পরামর্শ দেন তিনি।
সুমায়া বলেন, ‘স্টুডেন্ট টিউটর হওয়ার পর থেকে আমার সফট স্কিল বেড়েছে। আমি এখন দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়েছি। প্রতিদিনের কাজের বাইরে এখন আমি বিবিএ লিডারশিপ প্রোগ্রামের মডিউল তৈরির প্রকল্পে কাজ করছি। এই কাজের জন্য আমাকে মাইক্রোসফট এক্সেলে অনেক ডেটা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ডেটা সংরক্ষণ, বাছাই, বিশ্লেষণসহ এক্সেলের অনেক ফর্মুলা শিখেছি। ফলে আমার হার্ডস্কিলেও উন্নতি হয়েছে।’
তাসনিয়া হক টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউবিএটি)। সেখানে ইংরেজি বিভাগে সপ্তম সেমিস্টারে পড়ছেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাঁকে।
তাসনিয়া বলেন, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সেতুবন্ধ করাই হলো টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টদের কাজ। যেমন ক্লাসে পড়া না বুঝলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছে গিয়ে আলাদাভাবে পড়া বুঝে নিতে পারে। তবে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা সরাসরি শিক্ষকের কাছে যেতে সংকোচ বোধ করে। এ ক্ষেত্রে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ওই শিক্ষার্থীকে পরামর্শ দেন।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সানজিদা লিসা ‘পিআর মেন্টর’ হিসেবে কাজ করছেন। ইউল্যাবে স্নাতকপর্যায়ে ভর্তি হওয়ার পর নবীন শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য পিআর মেন্টর নিয়োগ দেওয়া হয়। একেকজন পিআর মেন্টরের অধীনে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি দল থাকে।
লিসা জানালেন, প্রতি সপ্তাহে তাঁকে তিন ঘণ্টা সময় দিতে হয়। শিক্ষার্থীদের কোর্স রেজিস্ট্রেশন, টিউশন ফি দেওয়ার প্রক্রিয়া কিংবা পড়াশোনাবিষয়ক যেকোনো সমস্যায় পরামর্শ দেন তিনি। এই কাজের জন্য তিনি সেমিস্টারভিত্তিক সম্মানী পান।
লিসা বলেন, টিউশন করে হয়তো এর চেয়ে বেশি উপার্জন করা সম্ভব। কিন্তু টিউশনের অভিজ্ঞতা সিভিতে যুক্ত করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অফিশিয়াল পরিবেশে কাজ করছেন। এই কাজের মাধ্যমে যোগাযোগ, সময় ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের দক্ষতা আয়ত্ত করছেন। এসব অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা পরবর্তী চাকরিজীবনেও কাজে লাগবে।
আইইউবিএটিতে কয়েক শিক্ষার্থী খণ্ডকালীন হিসেবে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ করেন। এর মধ্যে যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আফজাল হোসেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে যুক্ত আছেন। প্রায় দুই বছর ধরে এই কাজ করছেন তিনি।
আফজাল জানালেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক ক্লাবের সদস্য। শখের বশে ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতার জন্য ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার ও ভিডিও বানাতেন তিনি। শখের এই কাজই এখন তাঁর খণ্ডকালীন চাকরি। এখন নিজে কনটেন্ট বানানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যদেরও কনটেন্ট বানানো শেখান তিনি।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী ব্যবস্থাপক সাইক মাহমুদ জানান, ব্র্যাকের শিক্ষার্থীদের জন্য খণ্ডকালীন ও চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন কাজের সুযোগ আছে। খণ্ডকালীন কাজের জন্য শিক্ষার্থীরা মাসিক বেতন পান। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠানের আগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।
সাইক মাহমুদ আরও বলেন, অন ক্যাম্পাস জবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের দক্ষতা অর্জন করেন। ফলে এই তরুণেরা কর্মজীবনে প্রবেশের সময় অন্য চাকরিপ্রার্থীর চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকেন। আবার অন ক্যাম্পাস জবের সুযোগ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো ভালো সিজিপিএ। প্রতি সেমিস্টারে চাকরি নবায়নের সময় শিক্ষার্থীদের কাজের মান ও ফলাফল—দুটোই বিবেচনায় রাখা হয়। ফলে চাকরি করতে গিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি হবে, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই।