ক্যামেরা হাতে যিনি গল্প খোঁজেন

জুবায়ের তালুকদার
ছবি: সংগৃহীত

জুবায়ের তালুকদারের ইউটিউব চ্যানেলের ‘ডেসক্রিপশন’ অংশে লেখা আছে-‘দ্য গাই উইথ আ ক্যামেরা’। ক্যামেরার মানুষ। ক্যামেরা সঙ্গে নিয়েই একের পর এক ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এই তরুণ। সহজ-সাবলীল উপস্থাপনায় ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনার নানা দিক তুলে ধরেন জুবায়ের তালুকদারের। এখন পর্যন্ত তাঁর নিজ নামের চ্যানেলটিতে মোট ভিডিও তোলা হয়েছে একানব্বইটি। সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ছুঁয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার।

কীভাবে ‘ভিডিও তৈরি’ সংক্রান্ত ভিডিও তিনি তৈরি করা শুরু করলেন, সে গল্পই শুনছিলাম তাঁর কাছে।

শুরুর দিনের গল্পগুলো

বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখে ক্যামেরার কাজে হাতেখড়ি হয় জুবায়ের তালুকদারের। ঢাকার বনশ্রীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক আর ঢাকা সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নেভাল আর্কিটেকচার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে তিনি প্রথম হাতে পান সাধারণ মানের একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা আর কম্পিউটার। প্রথম বর্ষ শেষে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানোর প্রস্তুতি নেন। সদ্য কেনা কম্পিউটার আর ডিএসএলআর থাকায় ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনার পুরো কাজটিই সেবার নিজে করেছিলেন। এভাবেই হাতে কলমে শেখা শুরু করেন সিনেমার কারিকুরি। একটু একটু করে এ বিষয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে।

জুবায়ের বলছিলেন, ‘ক্লাসের ফাঁকে ছোট ছোট ভিডিও ধারণ করে প্রিয় শহর ঢাকার নানা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করতাম। নাম দিয়েছিলাম “ডিসকভার ঢাকা”’। ঢাকাকে আবিষ্কার করতে গিয়ে আদতে নিজেকেই আবিষ্কার করেছিলেন জুবায়ের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ভিডিওগুলো প্রশংসা পেতে শুরু করে। ‘স্ট্রিট ফুডস অ্যারাউন্ড ঢাকা’ নামে তাঁর একটি ভিডিও-ও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

বুয়েটের নৌস্থাপত্য ও নৌপ্রকৌশলের ছাত্রটি এবার ভিডিও নির্মাণ সংক্রান্ত পড়ালেখার পেছনে সময় দিতে শুরু করেন। ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও দেখে চলে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ।

ইউটিউবে যাত্রা শুরু

নিজের করা কাজগুলোকে এক সঙ্গে গুছিয়ে রাখার জন্য ২০১৬ সালে ইউটিউব চ্যানেল খোলেন জুবায়ের। বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে গেলে সেসব নিয়েই ছোট ছোট ভিডিও করে রাখতেন। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে করা তাঁর ভিডিও সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ট্রাভেল ভিডিও বানাতে শুরু করেন তিনি। এমনকি ঘুরতে ঘুরতে তুলে আনেন ভারতের দার্জিলিং শহরের নানা চিত্র। সেসব মিলিয়ে একটু একটু করে বড় হতে থাকে জুবায়েরের ‘ইউটিউব পরিবার’। বাড়তে থাকে সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা। ২০১৮ সালে তিনি অংশ নেন বাংলালিংক নেক্সট টিউবার আয়োজনে। সেখানে অর্জন করেন ‘অ্যাসপায়ারিং কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ এর সম্মাননা।

শখ থেকে পেশা

শখের কাজ নিয়ে এবার একটু ‘সিরিয়াস’ হতে শুরু করেন জুবায়ের। নতুন ক্যামেরা, গিম্বল কেনাসহ নিজেকে প্রস্তুত করার পেছনে আরও সময় দেন তিনি। বিভিন্ন রেস্তোরাঁর জন্য ভিডিও বানিয়ে দিতে শুরু করেন। এ ছাড়া পরিচিত কিছু এজেন্সির সঙ্গেও ছোট ছোট কাজ করে হাত অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিচিত ভাইয়ের সঙ্গে মিলে জুবায়ের শুরু করেন ‘লুমিয়ার স্টুডিও’ নামে ছোট্ট এক এজেন্সি। সেখানে ফেসবুকের জন্য নানা রকম ভিডিও বানাতেন তাঁরা। এত কিছুর পরও ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইউটিউব চ্যানেলে জুবায়েরের সাবস্ক্রাইবার ছিল মাত্র হাজার পাঁচেক।

সিদ্ধান্তে অটুট

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে এবার সিদ্ধান্ত নেন পুরোদমে চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন। এরই মধ্যে ডাক আসে ‘চিত্রগল্প’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। চিত্রগল্প মূলত ‘প্রি-ওয়েডিং ভিডিও’ নিয়ে কাজ করে। চিত্রগল্পের সঙ্গে তাঁর প্রথম কাজ ছিল বরিশালে। জুবায়েরের কাজ ছিল ভিডিও করা, আর সঙ্গে থাকতেন আলোকচিত্রী অভিজিৎ নন্দী। গল্প-আড্ডা আর এই নতুন অভিজ্ঞতা আনন্দ দেয় জুবায়েরকে। গ্রামীণ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সৌন্দর্যকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেন তিনি। কৃত্রিম আলোতে শহুরে পরিবেশে কাজ করার চেয়ে শহর থেকে দূরে, নির্জন গাঁয়ে কাজ করতেই তিনি স্বস্তি পান।

চাকমাদের বিয়ে নিয়ে আয়োজনে, সীতাকুণ্ডের বিয়ের আয়োজনসহ জুবায়েরের বানানো বিভিন্ন প্রি-ওয়েডিং ভিডিও এরই মধ্যে জনপ্রিয় হতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। গতানুগতিক কাজ না করে জুবায়ের প্রতিটি ভিডিওতেই নতুন কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেন। আর এ ক্ষেত্রে তাঁকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে চিত্রগল্প।

ফিরে আসা ইউটিউবে

এরই মধ্যে এল করোনা। যেহেতু বাইরে শুটিং করতে যাওয়ার সুযোগ কম, তাই ঘরে থেকেই ইউটিউবের জন্য ভিডিও বানানোর সিদ্ধান্ত নেন জুবায়ের। ছোট ছোট টিউটোরিয়াল বানানো শুরু করেন। খুব সহজে, হাতের কাছে থাকা মোবাইল দিয়েই কীভাবে চমৎকার ভিডিও বানানো যায়, সেই কৌশল শেখান তিনি। মুঠোফোন দিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র বানানোর কৌশলও পাওয়া যাবে তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে; এরই মধ্যে শুধু ইউটিউবেই যে ভিডিও দেখেছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। ঘরবন্দী সময়েই তাঁর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একে একে স্টপমোশন, ট্রাভেল ভ্লগ সম্পাদনাসহ নানা বিষয় নিয়ে ভিডিও তৈরি করেন তিনি।

ভিডিও তৈরি কিংবা গল্প বলা

জুবায়ের তালুকদার বলছিলেন, ‘ক্রিয়েটিভ ফিল্ম মেকিং শুধু ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজ সম্পাদনা নয়, বরং একটা গল্প বলার মতো। আমি শুধু স্বাধীনভাবে আমার দেখা গল্পগুলো বলতে চেয়েছি।’ তাঁর মতে ইউটিউব বা যে কোনো মাধ্যমের জন্যই হোক, ভিডিও তৈরির ইচ্ছে থাকলে আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। ভালো ক্যামেরা কেনা কিংবা দামি কম্পিউটার থাকার অপেক্ষা করা যাবে না। হাতের কাছে সাধারণ মোবাইল থাকলে সেটা দিয়েই শুরু করতে হবে। একবার ভিডিও বানানো শুরু করতে পারলে যার ভালো লাগবে, সে আর থেমে থাকবে না। নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অন্যকেও সৃষ্টিশীল ছবি নির্মাণে আগ্রহী করতে চান তিনি।