১.
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম আর দুর্নীতির খবরে চাউর দেশের সংবাদপত্র। প্রথম আলোসহ দেশের অন্যান্য খবরের কাগজে বড় বড় হরফে সেসব অনিয়মের নিত্যনতুন সংবাদ। একটির রেশ না কাটতেই আসে আরেকটি সংবাদ। চাঞ্চল্যকর এসব খবরের কিছু শিরোনামে লেখা—১. ভিসির মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিতেই নীতিমালা বদল, ২. বিস্তর অভিযোগ তবু তদন্ত কমিটির বিরোধিতায় উপাচার্য, ৩. বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেটাই প্রার্থীর বড় যোগ্যতা, ৪. কাছের মানুষদের শিক্ষক বানাতে উপাচার্যের যত আয়োজন, ৫. নিয়োগ আটকাতে স্বর্ণপদক পাওয়া প্রার্থীকে অপহরণ, ৬. অনুগতদের নিয়োগ দিতেই অনিয়ম, ৭. তিন শিক্ষক নিয়োগ বহু প্রশ্ন, ইত্যাদি। এসব অনিয়মের ফলাফল কী? শিক্ষার মানের অবনমন। মূল্যায়ন সূচকে যাচ্ছে তলানিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণমান কমছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রথম আলো জাতিকে জানিয়ে দিল, এটা কলেবরে বিশাল কিন্তু গুণমানে নিচে (২০ অক্টোবর ২০২০)। জাতির বিবেক শিক্ষকসমাজ কি এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির খবরে লজ্জা পান না? অন্তত একজন শিক্ষক তাঁর কলামে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত (৫ নভেম্বর ২০২০)।
২.
বিগত বছরগুলোতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম করে সেখানকার উপাচার্য এম আবদুস সোবহান একজন আলোচিত শিক্ষক। শীর্ষস্থানে থাকা ক্ষমতাধর মানুষ তিনি। কীই–বা করণীয় দেশের সাধারণ মানুষের, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। কাছের মানুষদের নিয়োগ দিতে তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন নীতিমালায় যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে অনেককে শিক্ষকতা পেশায় বসিয়েছেন। মার্কেটিং বিভাগে লেখাপড়া করা উপাচার্যকন্যা সানজানা সোবহান নিয়োগ পান ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। বিভাগে তাঁর মেধাক্রম ছিল ২১। আর উপাচার্যের সেই জামাতা শাহেদ পারভেজকে নিয়োগ দেওয়া হয় ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে। যদিও এমবিএ পরীক্ষায় জামাতা শাহেদ পারভেজের মেধাক্রম ছিল ৬৭। তবু কিছুটা আশার কথা এই যে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক ডজন চিঠির মাধ্যমে অনেক অনিয়মের কিছু নিয়োগ বাতিল করতে নোটিশ দেয় (প্রথম আলো, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০)। জানা যায়, আইন শিথিল করে উপাচার্য শুধু কন্যা-জামাতাকে নিয়োগই নয়, অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়িও দখল রেখে সরকারের ৫ লাখ ৬১ হাজার টাকার ক্ষতি করেছেন।
দেশের অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের চিত্র প্রায় একই রকম। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপ্রবাহে এটা স্পষ্ট যে নীতিমালা পরিবর্তন করায় ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ মেনে চলা চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার শর্ত এখন সর্বনিম্ন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আর তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। উপাচার্যদের বিলাসবহুল অফিস আর বাসনাবিলাসের কথাও আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ তাঁর কলামে লিখেছিলেন, দেশের উন্নয়ন খায় ঘুণপোকায়, আর বিশ্ববিদ্যালয় খায় দুর্নীতিবাজ উপাচার্যেরা। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুর্ভাগ্য এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন অনিয়মের তদন্ত করতেই এই মঞ্জুরি কমিশনের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তো না-ই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আচার্যের দপ্তর এসব অভিযোগের ব্যবস্থা নিতে পারে।
৩.
দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জাতির ইতিহাসে এটি এক বড় গর্বের জায়গা। বিগত দশকগুলোতে স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতাপ্রীতি, দুর্নীতি, নিয়োগ–বাণিজ্য আর রাজনৈতিক প্রভাবে বিভিন্ন অনিয়মের বেড়াজালে পড়েছে গর্বের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রথম আলোতে প্রকাশিত-অনুগতদের নিয়োগ দিতেই অনিয়ম (৪ আগস্ট ২০১৭), এই লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দুর্নীতির এক চমৎকার দলিল। এটি পড়লেই বোঝা যায় এখানে শিক্ষকতা পেশায় কারা কীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের সাড়ে ৮ বছরের মেয়াদে নিয়োগ পেয়েছেন মোট ৯০৭ জন শিক্ষক। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের সংখ্যাই প্রায় দুই হাজার। অনুগতদের নিয়োগ দিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল, বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া সংখ্যার কয়েক গুণ অতিরিক্ত নিয়োগ, বিজ্ঞপ্তি ছাড়া নিয়োগসহ বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেও নিয়োগ পেয়েছেন ১০ জন। এমনকি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াও শিক্ষক হতে পেরেছেন কেউ কেউ।
বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ব্যথিত মনে চোখ আটকে যায় ঢাবির বিজ্ঞানের শাখাগুলোয় শিক্ষক নিয়োগের সেই বিবেকে নাড়া দেওয়া খবরগুলোতে। সে সময় ২০১৬ সালে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের মাত্র দুটি স্থায়ী প্রভাষক পদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১১ জনকে। একই বছর মাস দুয়েক পরে, ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের চাহিদা না থাকলেও সিন্ডিকেট থেকে সরাসরি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ৪টি পদের বিপরীতে ৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। খুব পরিতাপের বিষয়, তাঁদের মধ্যে তিনজনের কোনো স্নাতকোত্তর ডিগ্রিই ছিল না! জাপান, আমেরিকা আর কানাডায় অবস্থান করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চশিক্ষিত মানুষের সান্নিধ্যে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক শিক্ষাব্যবস্থার আলাপচারিতায় এ কথা খুব¯স্পষ্ট যে, শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা কমপক্ষে পিএইচডি। শুধু তাই-ই নয়, আসলে পোস্টডকসহ গবেষণায় বেশিসংখ্যক গুণগত গবেষণাপত্রের অধিকারী যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ দেওয়া হয়। তাহলে আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়?
৪.
শুধু কম্পিউটারবিজ্ঞান বা ফলিত রসায়ন বিভাগেই নয়, বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষক নিয়োগের করুণ কাহিনি আছে। প্রথম আলোর খবরে জানা যায় ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া একাধিক প্রার্থীকে বাদ দিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে যথাক্রমে দশম ও দ্বাদশতম স্থান অধিকারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঢাবি ফার্মাসি অনুষদকে নিয়ে গত বছর ২৫ জানুয়ারিতে প্রকাশিত একই সংবাদপত্রের একটি লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই অনুষদের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপকের পিএইচডি গবেষণা থিসিসে ৯৮ শতাংশ হুবহু নকলের খবর বিবেকবান উচ্চশিক্ষিত মানুষকে খুব নাড়া দিয়েছিল।
ঢাবি বিজ্ঞানের শাখাগুলোয় নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত খবর হলো এখানকার অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে তুলনামূলক কম যোগ্য তিনজন প্রার্থীকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া। প্রায় ১০ মাস আগেই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন এই তিনজনকে নিয়োগের জন্য বাছাই করা হয় তখনই জোরালো প্রশ্ন উঠেছিল। সিলেকশন বোর্ডের সেই প্রশ্নবিদ্ধ সুপারিশ শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ না দেখে সেটাই বহাল থাকল। সচেতন শিক্ষাসমাজে বহু প্রশ্ন রেখে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া একজন ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী পাঁচজন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে ফলাফলে চতুর্থ ও দশম প্রার্থীরাই চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়ে গেলেন! অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের এই নিয়োগে যোগ্য প্রার্থীরাই বাদ পড়লেন। এতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে পিএইচডি করা মোরশেদা মাহবুব, যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা শুভ্র প্রকাশ নন্দী, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা জিনাত জেরিন হোসাইন ও জান্নাতুল ফেরদৌস এবং ঢাবি থেকে পিএইচডি করা শারমিন জামান ইমন। আর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া নাদিরা নাজনীন রাখি।
নিয়োগে সব অনিয়মের খবর সংবাদপত্রের পাতায় আসে না। ভিন্ন ভিন্ন কারণে। অনিয়মের বেড়াজালে পড়ে, হেরে গিয়ে, প্রথমবার নিয়োগের সুপারিশ না পেয়েও পরেরবার হবে এই আশায় থাকেন কেউ কেউ। সংবাদমাধ্যমে জানালে এক জীবনে তাঁদের আর হবে না। রসায়ন বিভাগের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হয়ে ঢাবি উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক ছাড়াও সহ-উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ ও সহ-উপাচার্য ইউসুফ হায়দার এই কয়জন শীর্ষস্থানীয় শিক্ষকদের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অত্যন্ত তিক্ত সে অভিজ্ঞতা। প্রভাবশালী মহলের বিশেষ ক্ষমতায় অনুগতদের নিয়োগ দিয়ে অতীতে এই রসায়ন বিভাগও সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। আরও হবে।
৫.
খুবই দুঃখজনক। স্বার্থের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুরুদায়িত্বকে অবহেলা করে বিভিন্ন রঙের রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতা প্রয়োগ করে নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে অনিয়মটাই নিয়ম হয়ে গেছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কালো থাবায় হারিয়ে যায় অনেক বড় স্বপ্ন। আর অন্ধকারে ডুবে যায় শিক্ষার্থীরা। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টসহ অন্য যাঁরা ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া তাঁদের বাদ দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া কেউ কেউ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হয়ে যান। ঢাকার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী পরিণতি, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। ঢাবির চারপাশে টিভি, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিন্তু এখানেই অনুগতের নিমিত্তে অনিয়ম, কীই-বা আশা অন্য কোথা?
তবে অনিয়ম নামক এই ব্যাধি সারাবে কে? বিবেকের পচন হলে, বাকি থাকে সংবাদপত্র আর সচেতন নাগরিক। যোগ্যদের পাশ কাটিয়ে অযোগ্যরা যখন জায়গা করে নেন, তাঁদের এই বিশেষ যোগ্যতার অন্তর্নিহিত মর্মকথা অফিসকক্ষের নামফলকে থাকা উচিত। সব ছাত্রছাত্রী সেই যোগ্যতার কথা জানতে পারবে। শিক্ষক ভালো না পড়াতে পারলে, কিংবা ভালো গবেষক তৈরি করতে না পারলে এটা তাঁদের ব্যার্থতা।
লেখক: পিএইচডি, রিসার্চ সায়েন্টিস্ট (জৈব রসায়ন), টরন্টো, কানাডা। ই–মেইল: sadeq78@yahoo.com