শিক্ষাবিদেরা বলছেন, দায়সারা এবং অপরিকল্পিতভাবে কাজ করায় এখন সংকটে পড়েছে এনসিটিবি।
নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়নের অন্তত এক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা চালু করতে হয়, সাধারণত এটিই নিয়ম। কিন্তু সপ্তম শ্রেণিতে তা না করেই সরাসরি নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে।
এ কারণে এই শ্রেণিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটি পরীক্ষামূলকভাবে পড়ানো হয়নি। ফলে এই বই নিয়ে মূল্যায়ন বা পর্যবেক্ষণেরও সুযোগ ছিল না। বইটিতে নানা ভুল, অসংগতি নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক ওঠার পর শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
তবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে গত বছর নির্ধারিতসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে চালু ছিল। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটি সম্পর্কে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন এবং পর্যালোচনার ফল পুরোপুরি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, এমন অভিযোগ উঠেছে।
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ বইটি মূল বই।মো. মশিউজ্জামানের, এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, এনসিটিবি দায়সারা, তাড়াহুড়া ও অপরিকল্পিতভাবে কাজ করায় এখন সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে একদিকে সরকারের বিপুল টাকার অপচয় হলো, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও ক্ষতির মুখে পড়ল।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা গতকাল শনিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৫ লাখের কাছাকাছি। প্রত্যাহার করা বই দুটি প্রায় ৫৫ লাখ শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়েছে।
একটি বই ছাপাতে সর্বনিম্ন ৩০ টাকা খরচ ধরলেও মোট ৫৫ লাখ বই ছাপাতে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা। তবে বই ছাপানোর কাজে যুক্ত একজন মুদ্রণকারী জানিয়েছেন, একেকটি বই ছাপাতে যে খরচের কথা এনসিটিবি বলছে, তা ঠিক নয়। বিতরণসহ সব মিলিয়ে একটি বই ছাপাতে গড়ে খরচ হয় প্রায় ৭০ টাকা। সেই হিসাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া দুটি বইয়ের পেছনে ব্যয় প্রায় সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা।
পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা সরকারি সংস্থা এনসিটিবি গত শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ‘২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের “অনুসন্ধানী পাঠ” পাঠ্যপুস্তক দুটি পাঠদান হতে প্রত্যাহার করা হলো।’ উল্লেখ্য, চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ওই দুটি বইয়ের নাম একই।
গত ১ জানুয়ারি প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, মাধ্যমিক স্তরের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে গত বছরই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন বইও দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে চলা শিক্ষাক্রম মূল্যায়নের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে পূর্ণমাত্রায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার কথা। বেশির ভাগ বইয়ের ক্ষেত্রে এই কাজ করা হলেও প্রত্যাহার করা দুটি বই এবং সংশোধনের তালিকায় থাকা বইগুলো পর্যাপ্ত পর্যালোচনা করা হয়নি। শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে বইয়ে।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে গত বছর ৬২টি স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা গেলেও প্রথম ও সপ্তম শ্রেণিতে সেটি করা যায়নি। এই দুই শ্রেণিতে এ বছর সরাসরি শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। এনসিটিবি সূত্র বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষা বিভাগের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রথম শ্রেণিতে গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়নি। এ জন্য এখন নতুন শিক্ষাক্রমের বইগুলোতে ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’ বলা হয়েছে।
প্রতিবার শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে মোটামুটি সব বই তুলে দেওয়া হলেও এবার সব শিক্ষার্থীর কাছে সব বই পৌঁছে দিতেও দেরি হয়েছে; আর শিক্ষাবর্ষ শুরুর পর থেকেই নতুন পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বইয়ে বেশ কিছু ভুল ও অসংগতি আছে। যদিও কিছু বিষয় নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা প্রকৃতপক্ষে পাঠ্যবইয়ে নেই।
বিতর্কের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভুল সংশোধনের জন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি এবং গাফিলতি চিহ্নিত করতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিয়ে আরেকটি কমিটিও গঠন করেছে। যদিও সেই দুই কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই এনসিটিবি ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটি প্রত্যাহার করেছে।
শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ বলছেন, ভুল–অসংগতি এবং বিতর্ক থাকলেও মূলত ‘রাজনৈতিক’ কারণেই দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে। নির্বাচনের বছরে পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক তুলে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলো যাতে কোনো সুযোগ নিতে না পারে, সেই চিন্তা থেকেই হয়তো সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ ছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে বলে এনসিটিবি জানিয়েছে। তবে প্রত্যাহার করা বই দুটির বিষয়বস্তু এখন কীভাবে পড়ানো হবে, তা নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্তিতে আছেন।
দুটি বই প্রত্যাহারের বিষয়ে কথা হয় এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ বইটি মূল বই।
আর ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটি (প্রত্যাহার করা) মূলত ‘রিসোর্স বই’। অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটি প্রত্যাহার করা হলেও ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা থেমে থাকবে না। ‘অনুশীলনী পাঠ’ বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষকেরা তা পড়াবেন।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেগুলো এ বছর সংশোধন করে দেওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নব্যবস্থা, পড়ানোর ধরন এবং বইগুলো পুরোপুরি বদলে গেছে। শিক্ষাবিদদের অনেকেই বলছেন, পদ্ধতিগতভাবে এটি ভালো। কিন্তু এত বড় পরিবর্তন হলেও বাস্তবায়নের কাজটিতে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেনি শিক্ষা বিভাগ। ফলে এখন দুটি বই প্রত্যাহারের মতো ঘটনা ঘটল।