এখন প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা ক্ষতিকর হবে: এম তারিক আহসান

একসময় বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে হতো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। সেটি বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা। এতে সব শিক্ষার্থীই বৃত্তি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। যদিও পিইসি পরীক্ষা নিয়ে ছিল সমালোচনা। করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বিবেচনায় নিয়ে তিন বছর ধরে পিইসি পরীক্ষা হচ্ছে না। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতেও তা বাস্তবায়ন করা হবে। যেখানে প্রথাগত পরীক্ষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বছরের একেবারে শেষ বেলায় এসে আকস্মিকভাবেই এ বছর সেই পুরোনো ব্যবস্থার মতো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ।
অধ্যাপক এম তারিক আহসান
অধ্যাপক এম তারিক আহসান
প্রশ্ন

প্রশ্ন: বছরের একেবারে শেষে এসে আকস্মিকভাবে এ বছর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

এম তারিক আহসান: বছরের শেষে এসে হঠাৎ প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তটি নেওয়া একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন ক্ষতিকর বিষয় হবে, তেমনি ভবিষ্যৎ শিক্ষাসংস্কারের জন্যও নেতিবাচক নির্দেশনা দিচ্ছে। তাই এটি নিয়ে আরেকটু ভাবার অবকাশ রয়েছে।

প্রশ্ন

প্রশ্ন: আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। সেখানে এখন উপজেলা সদরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?

এম তারিক আহসান: এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই এসেছে। বিষয়টিকে আমি ভিন্নভাবে দেখতে চাই। এর দুটো দিক রয়েছে। একটি হলো নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষায় পরিবর্তনের যে ধারা তৈরি হচ্ছে, সেখানে হঠাৎ করে সামষ্টিক পরীক্ষা নেওয়ার প্রচেষ্টা কখনোই ইতিবাচক চর্চা হতে পারে না, বরং ক্ষতির কারণ হতে পারে। কাজেই ভবিষ্যতের পরিবর্তনের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, এমন চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে। দ্বিতীয় দিক হলো প্রাথমিকে কিন্তু প্রায় সব শিক্ষার্থীই উপবৃত্তি পায়। পাশাপাশি মেধাকে উৎসাহিত করার জন্য বৃত্তি প্রদানের যে চর্চা এত দিন ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে, এই ধারণা আসলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী নয়। তাই এটিকে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। তারপরও যেহেতু এখনো বৃত্তি প্রদানের নীতিমালা পরিবর্তন হয়নি, তাই সেটি বিবেচনায় রেখে এখনকার বাস্তবতায় এই ধরনের বৃত্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা না করে শিক্ষার্থীরা যেসব কাজ করেছে; যেমন অ্যাসাইনমেন্ট, শ্রেণিভিত্তিক কার্যক্রমের ফলাফল ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে আপাতত মেধাবৃত্তি দেওয়া যেতে পারে। আমি সেটিকে বেশি যৌক্তিক মনে করি। হঠাৎ করে একটি পাবলিক পরীক্ষার মতো বা সামষ্টিক মূল্যায়ন না করা ঠিক হবে না।

প্রশ্ন

প্রশ্ন: প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী চালুর পর নীতিনির্ধারকেরা বলেছিলেন, এর মাধ্যমে সব শিক্ষার্থী বৃত্তি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। এখন নতুন করে যে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তাতে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের সুযোগ হবে, বাকিরা বাদ পড়বে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?

এম তারিক আহসান: ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাছাই করে যদি এই ধরনের একটি বৃত্তি কার্যক্রম আবার চালু করা হয়, তাহলে এটি আসলেই বৈষম্যমূলক হবে। বরং নতুন শিক্ষাক্রম যেখানে সব শিক্ষার্থীর মেধার সম্পূর্ণ বিকাশের নানা দিককে উৎসাহিত করতে চায়, তার ওপর ভিত্তি করেই আসলে নতুনভাবে ভাবতে হবে। শুধু লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের প্রাচীন ধারণার চর্চার আর সুযোগ থাকা উচিত নয়। কাজেই আমি মনে করি, এই বৈষম্য দূর করতে হলে বৃত্তির কাঠামোকেই নতুনভাবে ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীর কোনো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ থাকলে সেটিকে অতিক্রম করে যেন এগোতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সেই বাস্তবতায় আসলে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীর মেধাচর্চার ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদান নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার সঙ্গে যায় না। কাজেই সেটিকে বিবেচনায় রেখে আমাদের পুরো বৃত্তি প্রদানের কার্যক্রমটি নিয়েই নতুনভাবে ভাবতে হবে।

প্রশ্ন

প্রশ্ন: সাধারণত এ ধরনের পরীক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনেক সময় দিয়ে। কারণ, এখানে প্রস্তুতির বিষয় থাকে। কিন্তু প্রাথমিক বৃত্তির সিদ্ধান্তটি এসেছে আকস্মিকভাবে এবং খুবই কম সময় সামনে রেখে। এ রকমভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা সঠিক বলে মনে করেন?

এম তারিক আহসান: শিক্ষার্থীর একাডেমিক ও মানসিক বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি দেখি, তাহলেও এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের ওপর নানামুখী মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের ওপর নানা রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমি মনে করি, শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ভিত্তিক যেসব তথ্য রয়েছে, তার ফলাফলের রেকর্ডের ভিত্তিতে এই বিষয়টিকে পুনর্বিবেচনা করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।