এত দিন পরীক্ষা মানেই ছিল একই বেঞ্চে একজন, দুজন বা তিনজন বসা। পরীক্ষার হলে এক পরীক্ষার্থীর অন্য কারও সঙ্গে কথা না বলা। ঘাড় ঘোরালেই ধরা পড়া। সঙ্গে বই থাকলে তো কথাই নেই, পারলে বহিষ্কার। কিন্তু আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখা গেল একেবারে উল্টো চিত্র।
অধ্যক্ষের সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণির একটি পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখা গেল, একসঙ্গে গোল হয়ে বসেছে কয়েকজন শিক্ষার্থী। নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। তাতে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এর ভিত্তিতে খাতায় লিখছে। এমনকি, সঙ্গে আছে পাঠ্যবই। প্রয়োজনে সেখান থেকেও সহায়তা নেওয়ার সুযোগ আছে।
অন্যদিকে হলে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা তাৎক্ষণিকভাবেও পরীক্ষার কিছু অংশের মূল্যায়ন করে নির্ধারিত শিটে লিখে ফেলছেন। পরে উত্তরপত্রের ভিত্তিতে হবে বাকি মূল্যায়ন।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, এভাবেই নতুন নিয়মে হচ্ছে মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কাজ। শুধু রাজধানীর উদয়ন বিদ্যালয়েই নয়, আজ থেকে সারা দেশেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয়েছে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন বা প্রচলিত অর্থে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে সারা দেশের এক কোটির মতো শিক্ষার্থী এই মূল্যায়ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ
এবার কেন্দ্রীয়ভাবে এনসিটিবির তৈরি করা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নের ভিত্তিতে হচ্ছে মূল্যায়ন কার্যক্রম। নতুন নিয়ম হওয়ায় এবার এনসিটিবি থেকে মূল্যায়নে শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্ন তৈরি করে তা পরীক্ষার আগের দিন প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে অনলাইনে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা প্রশ্নপত্র ডাউনলোডের পর ফটোকপি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করছেন।
অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষার আগের দিন গতকাল মঙ্গলবার রাতে এবং আজ সকালে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মূল্যায়ন কার্যক্রমের শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে উত্তর তৈরি করেও ছড়ানো হয়। পর দেখা যায়, আজ অনুষ্ঠিত মূল্যায়ন কার্যক্রমের শিক্ষার্থী নির্দেশিকার সঙ্গে ফাঁস হওয়া নির্দেশিকার হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের একাধিক অভিভাবক এই অভিযোগ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বলেন, তাঁর সন্তান সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। যে প্রশ্নপত্রটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে ছিল, তার সঙ্গে আজ অনুষ্ঠিত মূল্যায়নের প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। যখন একজন শিক্ষার্থী এটি দেখে, তখন তার দৃষ্টি এর ওপর পড়ে। তখন সে আর অন্য কিছু পড়তে বা শিখতে চাইবে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নের যে ধরন এবং যেভাবে লিখতে হবে, তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও বড় কোনো সমস্যা হবে না। গত বছর কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই নির্দেশিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল; কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে এই প্রশ্নপত্রের ভিত্তিতে তথাকথিত উত্তরপত্র লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এতে মূল্যায়ন কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে জরুরি নোটিশ দিয়ে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের বলা হচ্ছে, এরপর যদি কারও আইডি থেকে তা বাইরে যায়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতেও চালু হয়েছে এ শিক্ষাক্রম। ২০২৭ সালে এটা দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে। এ বছর যারা নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তারাই নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে হতে পারে এ পরীক্ষা। নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন ও মূল্যায়নে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে।
‘নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নের যে ধরন এবং যেভাবে লিখতে হবে, তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও বড় কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু সমস্যাটি হলো, এই প্রশ্নপত্রের ভিত্তিতে তথাকথিত উত্তরপত্র লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন।’অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান, চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব), এনসিটিবি।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী কেন্দ্রভিত্তিক পাবলিক মূল্যায়নে (এসএসসি পরীক্ষা) লিখিত অংশের ওয়েটেজ হবে ৬৫ শতাংশ ও কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ৩৫ শতাংশ। একেকটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে সর্বোচ্চ এক স্কুল দিবস (দিনে যতক্ষণ স্কুল চলে)। আগের মতো জিপিএর ভিত্তিতে ফলাফল প্রকাশ হবে না। শিক্ষার্থীর নির্ধারিত পারদর্শিতা অনুযায়ী সাতটি স্কেল বা সূচকে ফলাফল বা রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করা হবে। এত দিন আলোচনা হয়েছিল, এ সাত স্কেলের ঘর ভরাট অনুযায়ী ফলাফল বোঝানো হবে। এখন সেটি না করে ইংরেজি বর্ণ (এ, বি, সি ইত্যাদি) দিয়ে বোঝানো হবে। তবে এই লেটার গ্রেড এখনকার মতো নম্বরের ভিত্তিতে হবে না। পারদর্শিতার স্তর অনুযায়ী হবে।
এনসিটিবি জানিয়েছে, শিক্ষকেরা এখনো এ কাঠামোর প্রশ্নপত্রে অভ্যস্ত নন। তাই এখন কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্ন তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। তবে এরপর আর এনসিটিবি প্রশ্নপত্র তৈরি করবে না। প্রশিক্ষণ পেতে যাওয়া শিক্ষকেরা এই প্রশ্নপত্র তৈরি করে দেবেন। যার যার বোর্ডের জন্য আলাদা প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। এভাবে কয়েক বছর চলার পর পরে বিদ্যালয়গুলো নিজেরাই কাঠামো অনুযায়ী প্রশ্নপত্র তৈরি করবে। অন্যদিকে এবারের এই সামষ্টিক মূল্যায়ন পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন চূড়ান্ত হবে।
কেমন প্রশ্নে হচ্ছে মূল্যায়ন
বিষয় ও শ্রেণিভেদে খাবার বা টিফিনের বিরতি দিয়ে চার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় হচ্ছে এ মূল্যায়ন। যেমন অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য পাঁচ ঘণ্টা এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য চার ঘণ্টায় হচ্ছে মূল্যায়ন। সময়সূচি অনুযায়ী, নির্ধারিত দিনে একটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে। বিরতি দিয়ে এ মূল্যায়নের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে মাসব্যাপী চলবে মূল্যায়ন কার্যক্রম।
এবার হাতে-কলমে কাজ ও কার্যক্রমভিত্তিক লিখিত অংশের ভিত্তিতে হচ্ছে মূল্যায়ন। প্রশ্নের ধরন একেবারে ভিন্ন। যেমন ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বিষয়ের মূল্যায়নে প্রশ্নপত্রে বলা হয়, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। অনুষ্ঠানের এক অংশে থাকবে আলোচনা সভা, আরেক অংশে থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
এর ভিত্তিতে মূলত অনুষ্ঠানটি কীভাবে আয়োজন করা হবে, সেটি নিয়েই মূলত মূল্যায়নের প্রশ্নগুলো বা কী কী করতে হবে, তা সাজানো হয়েছে। এতে তিনটি ভাগে মূল্যায়ন কার্যক্রমটি করতে বলা হয়। প্রথম কাজ হিসেবে এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জোড়ায় আলোচনার ভিত্তিতে কাজগুলো করতে বলা হয়। যেমন প্রথমে জানতে চাওয়া হয়, এ অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে কথা বলা যায়, এমন একটি তালিকা তৈরি করতে। প্রথমে নিজে নিজে একটি তালিকা করে খাতায় লিখতে হবে। এরপর জোড়ায় থাকায় সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করে নতুন কোনো ব্যক্তি খুঁজে পেলে তা খাতায় লিখতে বলা হয়। সর্বশেষ দুটি তালিকা একসঙ্গে করে একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করতে হবে। তারপর এই তালিকা থেকে যেকোনো একজন ব্যক্তির নাম বাছাই করতে হয়। তারপর বাছাই করা ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা তৈরি করতে হবে। তাতে সর্বনাম অনুযায়ী ক্রিয়া শব্দের মর্যাদা বজায় রাখতে হবে। এ ছাড়া তাতে বিবৃতিবাচক, প্রশ্নবাচক, অনুজ্ঞাবাচক ও আবেগবাচক বাক্য ব্যবহার করতে হবে।
দ্বিতীয় কাজ হিসেবে শিক্ষার্থী কীভাবে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চায়, তা নিয়ে একটি ছোট (১০০ শব্দের মধ্যে) অনুচ্ছেদ লিখতে হবে। অনুচ্ছেদে অন্তত পাঁচ শ্রেণির শব্দের ব্যবহার থাকতে হবে। এ ছাড়া অন্তত পাঁচ ধরনের যতিচিহ্নের ব্যবহার থাকতে হবে। এর ভিত্তিতে আরও কিছু বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। বিপরীত শব্দ, প্রতিশব্দও জানতে চাওয়া হবে।
তৃতীয় কাজ হিসেবে বলা হয়, এই অনুষ্ঠান আয়োজন ঘিরে সাইনবোর্ড, পোস্টার, ব্যানার, আমন্ত্রণপত্র কিংবা বিজ্ঞাপনের মধ্যে থেকে যেকোনো একটির নমুনা লেখা খাতায় তৈরি করতে বলা হয়। কাজটি হবে একটি দলীয় কাজ। পাঁচজনের দলে কাজটি হবে।
উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জহুরা বেগম প্রথম আলোকে বললেন, এই মূল্যায়নে প্রশ্ন বা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা একেবারে ভিন্ন। এতে একেকজন শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা একেক রকম হবে। মুখস্থ করে লেখার সুযোগ নেই। উত্তরপত্র দেখেই ধারণা করা যাবে এটি শিক্ষার্থী নিজে থেকে লিখেছে, নাকি অন্য কোনো উপায়ে লিখেছে।