রাজধানীর বকশীবাজারে অবস্থিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ঢাকা অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল কলেজ। বিশ্বখ্যাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ডের নামের সঙ্গে মিল থাকলেও বাস্তবে কোনোই মিল নেই মালিবাগের এই কলেজটির। এবারের এইচএসসিতে এখান থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন মাত্র তিনজন। কিন্তু তাঁদের কেউ পাস করতে পারেননি।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশ থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেননি। গতবার এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল পাঁচটি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর মালিবাগের এই কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় একদল অভিভাবক বসা, যাঁদের সঙ্গে রয়েছে শিশুরা। দোতলার অফিসকক্ষে গিয়ে কথা হয় একজন শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এখানে স্কুল ও কলেজ আলাদা চলে। এখন স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে।
সেখান থেকে পরে স্কুলভবন লাগোয়া পাশের ঘরের একটি কক্ষে কলেজের অধ্যক্ষ সাহাবুদ্দিন মজুমদারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করলেন, তাঁদের কলেজ থেকে এবার ২৭ জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা দেন মাত্র তিনজন। তাঁর দাবি, বাকি পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র আসার পর তাঁদের বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়েও পরীক্ষায় বসাতে পারেননি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চলছে ভাড়া করা এই বাড়িতে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি মিলিয়ে কলেজটিতে এখন ৩০ জন শিক্ষার্থী ও ২৪ জন শিক্ষক আছেন বলে জানালেন অধ্যক্ষ।
অবশ্য সরেজমিনে কলেজের অন্য কোনো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে পাওয়া গেল না। অধ্যক্ষ বললেন, বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থাকায় এদিন তাঁরা আসেননি।
শুধু ঢাকার এই কলেজটিই নয়, এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশ থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেননি। গতবার এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল পাঁচটি।
গত বুধবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির ফলাফলের তথ্য বলছে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৪টি ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন। এর মধ্যে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের ১৩টি, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের ৯টি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ৮টি, যশোর শিক্ষা বোর্ডের ৬টি, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ৫টি এবং ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের অধীন ৩টি কলেজ রয়েছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ৪টি মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন দুটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি।
সরেজমিনে কয়েকটি কলেজে দেখা গেছে, এগুলো মূলত নামকাওয়াস্তে চলছে। ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। পড়াশোনার সুযোগ–সুবিধাও কম। বেশির ভাগ কলেজেই পরীক্ষার্থী ছিলেন অল্প কয়েকজন। এমনকি কোনো কোনো কলেজ থেকে মাত্র একজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
অভিযোগ আছে, এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘নানাভাবে’ পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়। কিন্তু সেগুলো পরে আর শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে তদারক করা হয় না। তখন প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলে। অন্যদিকে অনেকেই ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি বা নামের জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কিন্তু কলেজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য যেসব সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার, সে বিষয়ে তাঁরা মনোযোগী হন না।
এর আগেও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় এ রকম কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। যেমন গত বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাতেও ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের ফলাফলের তথ্য বলছে, এবার শূন্য পাসের বাইরেও ৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার ৫ শতাংশের মধ্যে। ১০টিতে পাসের হার ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। ৪৫টিতে পাসের হার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। ৫১৯টিতে পাসের হার ২০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে। ৭ হাজার ১৭৮টিতে পাসের হার ৫০ থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে। আর ১ হাজার ৩৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সব শিক্ষার্থীই পাস করেছেন। ২০২১ সালের পরীক্ষায় এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ১ হাজার ৯৩৪টি।
শূন্য পাস করা কলেজের একটি হলো মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আফরোজা রমজান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এখান থেকে ৪ জন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেননি। জেলা শহরের শহীদ রফিক সড়কের পাশে কলেজটির অবস্থান। মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. রমজান আলীর স্ত্রীর নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। কলেজটি এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ সরকারি অনুদান পায় না) নয়।
গতকাল সকালে কলেজে গিয়ে দেখা যায়, অল্প জায়গার ওপর বিদ্যালয় ও কলেজ শাখার তিনটি ভবন রয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাহনাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এবার ছয়জন শিক্ষার্থীর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তবে তার আগেই দুজন ঝরে পড়ে।
রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মদাপুর ইউনিয়নের কাটাবাড়িয়া গ্রামে অবস্থিত নূর নেছা কলেজ থেকে ৪ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কলেজের দুটি টিনশেড ভবনে কক্ষ ১৩টি। এর মধ্যে ছয়টি শ্রেণিকক্ষ। আরেকটি টিনশেড ভবন নির্মাণাধীন। বর্তমানে একাদশ শ্রেণিতে ৬০ জন এবং দ্বাদশে ৪২ শিক্ষার্থী রয়েছে।
কলেজের অধ্যক্ষ মামুনুর রশীদ বলেন, করোনার কারণে পাঠদান বন্ধ ছিল। কিন্তু তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ওই পরীক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়েছিল।
একজনও পাস করতে না পারা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার অলোয়া হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মানবিক শাখায় দুজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান জানান, কলেজে শিক্ষার্থীরা দু-চারজন যা–ও ভর্তি হয়, নিয়মিত ক্লাসে আসে না।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাইককান্দি ইউনিয়নের ডা. দেলোয়ার হোসাইন মেমোরিয়াল কলেজ থেকে ৪ জন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেননি। এখানে কাগজ–কলমে ১৩ জন শিক্ষক থাকলেও বেতন না পাওয়ায় কোনো শিক্ষক কলেজে আসেন না। এখন কোনো শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত নেই। এই জেলার কাশিয়ানী উপজেলার রাতইল আইডিয়াল কলেজ থেকে ৩ জন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করতে পারেননি।
জানতে চাইলে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এখন নিজস্ব জমি ও অবকাঠামো ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ নেই। কিন্তু একসময় নানা কৌশলে অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে পাঠদানের অনুমতি বা স্বীকৃতি পেয়ে যেত। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করছে না, তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ করেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এ জন্য তাদের আরও সময় দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল, প্রতিনিধি, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ী]