পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা ও ঢাকায় গণিতে ভালো না করা বড় কারণ।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার গত বছরের চেয়ে সাত শতাংশ কমেছে। জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থী কমেছে সাড়ে ৭৪ হাজারের বেশি।
সব মিলিয়ে ফলাফল গত বছরের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এমনকি স্বাভাবিক সময়, অর্থাৎ ২০২০ সালের চেয়েও এবার পাসের হার কিছুটা কমেছে।
দুটি কারণে এবার ফলাফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষকেরা। প্রথমত, এ বছর পরীক্ষা হয়েছে সব বিষয়ে এবং পূর্ণ নম্বরে। করোনার সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর (২০২১ ও ২০২২) অনেকটা ছাড় দিয়ে কম নম্বরে ও কম বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছিল। তখন ফল বেশি ভালো হয়েছিল। এ বছর পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা হয়। তবে আগের মতো সব বিষয়ে ও পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের।
দ্বিতীয়ত, এবার কঠিন বিষয় হিসেবে পরিচিত গণিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা বেশ খারাপ করেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থী বেশি। তাই এই বোর্ডের ফলাফলের প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলের ওপর।
এবার পূর্ণ নম্বরে সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার পাসের হার কিছুটা কমবে, এটাই স্বাভাবিকশিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ এপ্রিল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মাথায় গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ফলাফল প্রকাশিত হয়।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল প্রকাশের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনলাইনে একযোগে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বেলা ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় গড়ে ৮১ শতাংশ পাস করেছে, যা গত বছর ছিল ৮৮ শতাংশের সামান্য বেশি। এবার পরীক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯১৯। এর মধ্যে পাস করেছে ১৩ লাখ ২২ হাজার ৪৪৬। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২২০ শিক্ষার্থী। গত বছর সংখ্যাটি ছিল ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৩।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, এবার পূর্ণ নম্বরে সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার পাসের হার কিছুটা কমবে, এটাই স্বাভাবিক।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কঠিন বিষয় হিসেবে পরিচিত ইংরেজিতে ভালো ফল করেছে শিক্ষার্থীরা। নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সব কটিতেই ইংরেজি বিষয়ে পাস করেছে ৯০ শতাংশের বেশি। যেমন রাজশাহীতে ইংরেজিতে পাসের হার প্রায় ৯৭। বরিশালে ৯৬ ও ঢাকায় ৯১ শতাংশ।
আরেক কঠিন বিষয় গণিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮১-এর কিছু কম। অন্য বোর্ডগুলোতে এই হার অনেক বেশি, ৮৬ থেকে ৯৯ পর্যন্ত। গণিতে যশোরের প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গণিতের সৃজনশীল ও এমসিকিউ (বহু নির্বাচনী প্রশ্ন)—দুই অংশের প্রশ্নপত্রই কঠিন হয়েছিল। এ জন্য এ বোর্ডে পাসের হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ কমেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২০ সালে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮২-এর বেশি। অথচ এবার পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৭৭ দশমিক ৫৫।
তপন কুমার সরকার বলেন, এর একটা প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে। করোনার সংক্রমণের কারণে পড়াশোনার গতিও কমে গিয়েছিল, যা পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগছে।
পরীক্ষায় অংশগ্রহণের দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল ছাত্রীরা। এবার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক দিয়েও ছাত্রদের পেছনে ফেলেছে ছাত্রীরা। এবার এসএসসিতে ছাত্রীদের পাসের হার ৮২-এর বেশি। ছাত্রদের পাসের হার ৮০-এর কিছু কম। অবশ্য বিগত পাঁচ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিবারই পাসের হারে ছাত্রীরা এগিয়ে ছিল।
শুধু পাসের হার নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও এগিয়ে ছাত্রীরা। এবার জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রীর সংখ্যা ৮৮ হাজার ২৪৫ ও ছাত্র ৭০ হাজার ৯৭৫; অর্থাৎ ছাত্রদের চেয়ে ১৭ হাজার ২৭০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের দিক দিয়ে এগিয়ে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড—৯০ শতাংশের বেশি। ঢাকায় প্রায় ৭৮, রাজশাহীতে ৮৮, কুমিল্লায় ৭৮, যশোরে ৮৬, চট্টগ্রামে ৭৮, দিনাজপুরে ৭৭, সিলেটে ৭৬ ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক দিয়ে এগিয়ে ঢাকা বোর্ড। এই বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৬ হাজার ৩০৩ শিক্ষার্থী।
এদিকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। অন্যদিকে ২ হাজার ৩৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সব পরীক্ষার্থী পাস করেছে।
এবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গণিতের সৃজনশীল ও এমসিকিউ (বহু নির্বাচনী প্রশ্ন)—দুই অংশের প্রশ্নপত্রই কঠিন হয়েছিল। এ জন্য এ বোর্ডে পাসের হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ কমেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২০ সালে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮২-এর বেশি। অথচ এবার পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৭৭ দশমিক ৫৫। এর একটা প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে। করোনার সংক্রমণের কারণে পড়াশোনার গতিও কমে গিয়েছিল, যা পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগছে।তপন কুমার সরকার, চেয়ারম্যান, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড
রাজধানীতে গতকাল আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম তিন সংগঠন এবং বিএনপির পৃথক কর্মসূচি নিয়ে একধরনের আতঙ্ক ছিল। তার ওপর ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্যান্যবারের মতো ঘটা ঘরে আনন্দ-উল্লাস হয়নি। তবু কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল।
যেমন গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কিছু ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকেরা মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলে জানা গেল, প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় ১২টার পর ঢুকতে দেওয়া হবে।
পরীক্ষার্থী নাওরোন সাইয়েরা বলল, সে এবার বিজ্ঞান শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাসায় বসেই ফল জেনেছে। বিদ্যালয়ে এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করতে।
অনলাইনে ফলাফল সংগ্রহ করতে মানুষের আগ্রহ কেমন ছিল, তা জানা যায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট মঞ্জুরুল কবীরের সঙ্গে কথা বলে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফলাফল প্রকাশের প্রথম আধা ঘণ্টার মধ্যে ওয়েবসাইটে ১০ লাখবার প্রবেশ (হিট) করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।