প্রায় এক বছর পর শুধু স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খোলা হচ্ছে। তবে পরীক্ষা শেষেই শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে হবে। পরীক্ষার প্রবেশপত্রধারী শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষার সময়ে হলে থাকতে পারবেন। এ নিয়ে আজ সোমবার বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বৈঠকে ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আগে হলে থাকতেন না, এমন পরীক্ষার্থীদেরও হলে থাকার সুযোগ দেওয়া এবং করোনাকালের বিভিন্ন ফি মওকুফের দাবি জানানো হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতোই গত বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। গত ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ১৩ মার্চ থেকে আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । তবে প্রথম পর্যায়ে শুধু স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের হলে তোলা হবে।
হল খোলা এবং আসন্ন শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন প্রসঙ্গে সোমবার দুপুরে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের মিথস্ক্রিয়ার প্ল্যাটফর্ম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদের’ বৈঠক হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এই বৈঠক হয়। বৈঠকে সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিজেদের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের সহযোগিতা চান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।
বৈঠক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরীক্ষার সময়সূচি অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুধু স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের আবাসিক শিক্ষার্থীদের আগামী ১৩ মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে হলে থাকার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সভায় অবহিত করা হয়। সভায় জানানো হয়, পরীক্ষার প্রবেশপত্রধারী সংশ্লিষ্ট আবাসিক শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষা চলাকালে হলে অবস্থান করতে পারবেন এবং পরীক্ষা শেষ হলেই হল ত্যাগ করবেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে এ বছর জনসমাগম এড়ানোর জন্য সংগঠন পর্যায়ে একটি ব্যানারের অধীনে সর্বোচ্চ পাঁচজন এবং ব্যক্তিপর্যায়ে সর্বোচ্চ ২ জন শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং মাস্ক পরতে হবে।
পরিবেশ পরিষদের আজকের বৈঠকে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও অংশ নেন সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূইয়া।
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেছিলেন, স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষার্থীদের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে ১৩ মার্চ থেকে হল খুলে দেওয়া হবে। স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত যেসব শিক্ষার্থীর হলের আবাসিকতা আছে, তাঁদেরই হলে ওঠানো হবে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফেরার আনুমানিক দুই সপ্তাহ পর তাঁদের পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। এই দুই সপ্তাহ কক্ষগুলো থাকার উপযোগী করা, পড়াশোনার ছন্দে ফেরা—অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ও হলের সামগ্রিক প্রস্তুতির জন্য দেওয়া হবে। এ সময়ে কোনো ক্লাস নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। তবে শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা করতে চান, তা করা যাবে।
ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা যা বললেন
পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন, করোনার আগে হলে থাকতেন না, এমন পরীক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনে ছাত্রলীগের পদধারী নেতারা তাঁদের হলের সিট ছেড়ে দেবেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক এজিএস সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসন শুধু স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষার্থীদের জন্য হল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা বিকল্পভাবে আরও বাড়তি কিছু দাবি করেছি। অনাবাসিক যেসব পরীক্ষার্থী আছেন, তাঁদের জন্য আমরা পরিবহনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছি। অনেক পরীক্ষার্থী আছেন, যাঁরা করোনার শুরুতে এক বছর আগে ঢাকার মেস ছেড়ে দিয়ে মফস্বলে চলে গেছেন।
তাঁদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের আবাসন নিশ্চিত করতে অপারগ, তাঁরা যদি সংশ্লিষ্ট হল প্রাধ্যক্ষের কাছে আবেদন করেন, সমন্বয় করে তাঁদেরও যেন হলে থাকতে দেওয়া হয়, এটিও আমরা দাবি করেছি। এ ছাড়া প্রশাসনের আগের ঘোষণা অনুযায়ী সব বিভাগে যেন ৫০ শতাংশ উন্নয়ন ফি মওকুফ করা হয়, সেই দাবিও আমরা জানিয়েছি।’
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব আমানউল্লাহ আমান জানালেন, তাঁরাও বৈঠকে প্রশাসনের কাছে দুটি দাবি জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসন বলেছে, আগে যাঁরা হলে ছিলেন, শুধু তাঁরাই হলে উঠতে পারবেন। কিন্তু আগে তো সবাই হলে ছিলেন না, অনেকে ঢাকায় টিউশন বা খণ্ডকালীন চাকরি করে মেস ভাড়া করে ঢাকায় থাকতেন। করোনা পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকেই মেস ছেড়ে দিতে হয়েছে। মানবিক দিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি শুধু হলে থাকা শিক্ষার্থীদের ওঠার সুযোগ দেয়, তাহলে হলের বাইরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কী হবে?
ঢাকায় এসে তাঁরা থাকার জায়গা পাবেন কোথায়? তাই আমরা সব পরীক্ষার্থীকে হলে ওঠার সুযোগ দিয়ে তাঁদের আবাসনও নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু প্রশাসন মনে করে যে আগে যাঁরা বাইরে ছিলেন, তাঁরা নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন। পরে বৈঠকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, যাঁদের খুব বেশি প্রয়োজন, তাঁরা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টি দেখবেন।’
আমান আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের গত বছরের জুন পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধ করতে বলেছে। সেখানে উন্নয়ন ফি, পরিবহন ফি, গ্রন্থাগার ফি পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো করোনার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবাগুলো নেননি। তাহলে এসব ফি কেন দিতে হবে? তাই পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে আমরা এগুলো মওকুফ করার দাবি জানিয়েছি। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন বলেছে, আলোচনা করে পরে এ বিষয়ে জানানো হবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার আগে শিক্ষার্থীদের অনেকেই ঢাকায় মেস নিয়ে থাকতেন, কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের মেস ছাড়তে হয়েছে। তাঁদেরও যেন হলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়, পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে আমরা সেই দাবি জানিয়েছি।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও আমরা জানিয়েছি, যাতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সেটি অনুসরণ করতে পারে। এ ছাড়া গত এক বছরের বিভিন্ন ফি (উন্নয়ন ফি, পরিবহন ফি ইত্যাদি) মওকুফ করে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী বর্ষে ভর্তি করার দাবিও আমরা করেছি।’