খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

ছেলে, মেয়ে, শ্যালক ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য

নতুন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শহীদুর রহমান খানের অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির চিত্র উঠে এল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে। এতে দেখা যায়, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক–শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই তা আটকে যায়।

সব মিলিয়ে উপাচার্য নিজের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে নয়জনকে নিয়োগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। ইউজিসির তদন্তে স্বজনপ্রীতি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণও উঠে এসেছে।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের পাঁচজন সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির অপর সদস্য হলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফরোজা পারভীন ও ইউজিসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক গোলাম দস্তগীর (সদস্যসচিব)। গঠনের এক বছরের বেশি সময় পর তদন্ত কমিটি ২৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয়।

এ প্রতিবেদনে যেসব অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে তদন্ত কমিটিতে উপাচার্য ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক জরুরি প্রয়োজনে নিয়োগ দেওয়ার যুক্তি তুলে ধরেন। তবে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কমিটিকে বলেন, ‘এটা আসলে খুব একটা ভালো কাজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করতে গিয়ে এ রকম করতে হয়েছে। আমি এ অন্যায় কাজটি করেছি।’

স্বজনদের নিয়োগ

২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উপাচার্য হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শহীদুর রহমান খানকে নিয়োগের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়। এখন সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাধিক। তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৭৩ জন শিক্ষক, ৩০ জন কর্মকর্তা (স্থায়ী ও অস্থায়ী) এবং ২৩১ জন কর্মচারীসহ (স্থায়ী ও অস্থায়ী) বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট জনবল আছে ৩৩৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০ জন কর্মকর্তা ও ৪৭ জন কর্মচারী নিয়োগ হয় অস্থায়ী ভিত্তিতে।

তদন্তে উঠে আসে, উপাচার্য নিজের ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসীম উদ্দীনকে নিয়োগ দিয়েছেন শাখা কর্মকর্তা পদে। চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা উপাচার্যের ভাতিজা। তাঁরা হলেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মুরাদ বিল্লাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে সুলতান মাহমুদ, ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে ইমরান হোসেন ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মিজানুর রহমান। শ্যালিকার ছেলে সায়ফুল্লাহ হককে নিয়োগ দেওয়া হয় সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নিজামউদ্দিন উপাচার্যের আত্মীয়। তাঁদের সবাইকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অবশ্য অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে নতুনগুলোতে প্রথমে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর নানাভাবে তাঁদের স্থায়ী করা হয়।

মেয়েকে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় ত্রুটি

বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের মেয়ে ইসরাত খানকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটি ত্রুটিযুক্ত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, উপাচার্যের মেয়ে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রভাষক পদে আবেদন করেন। এ পদে ৩০ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন, যাদের মধ্যে স্নাতক পর্যায়ের ফলাফলে পিছিয়ে ছিলেন উপাচার্য–কন্যা। তাঁর সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩০।

কেন কম সিজিপিএ পাওয়া প্রার্থীকে নির্বাচন করা হলো, এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে বাছাই বোর্ডের সদস্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমারনাথ তদন্ত কমিটিকে বলেন, একজন প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করার আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি তাঁর বাচনভঙ্গি, উপস্থাপনার কৌশল, বোর্ডে উপস্থাপিত শিক্ষকদের সামনে দেওয়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, ইংরেজিতে বলার দক্ষতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করা হয়।

অবশ্য তদন্ত কমিটি বলেছে, প্রার্থীদের পাঠদানের দক্ষতা যাচাই করার কোনো প্রমাণাদি কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়নি। এ ছাড়া বাছাই বোর্ডে দুজন শিক্ষককে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়, যার কোনো সুযোগ নেই।

তদন্ত কমিটি বলেছে, উপাচার্যের মেয়েকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে।

শুধু মেয়েকে নয়, উপাচার্য নিজের স্ত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। উপাচার্যের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। তবে এ নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি বলছে, উপাচার্যের স্ত্রী নিয়োগের শর্তই পূরণ করেন না।

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়া মো. আশিকুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা যোগ্যতার চেয়ে কম। তিনি ডিভিএমে (স্নাতক সম্মান) দ্বিতীয় শ্রেণি এবং এমএসসিতে প্রথম শ্রেণি পাওয়া।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল, প্রার্থীকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ন্যূনতম সাড়ে ৩ (যা প্রথম শ্রেণির সমান) পেতে হবে। এ শর্ত শিথিল করা যাবে, যদি প্রার্থীর পিএইচডি ডিগ্রি থাকে। কিন্তু আশিকুল আলমের পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না। তিনি উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের অধীনে গবেষণারত ছিলেন।

এ বিষয়ে প্রথম আলোকে আশিকুল বলেন, প্রতিবেদনে কী আছে, তা তিনি জানেন না।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ

ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে উপাচার্যের কন্যার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া, স্ত্রীকে সরাসরি অধ্যাপক বানানোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা এবং সব নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অঞ্চলপ্রীতি না করাসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের প্রতিটি বাছাই বোর্ডে পর্যবেক্ষক হিসেবে ইউজিসির একজন প্রতিনিধি মনোনয়নের সুপারিশ করা হয়।

জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে ঘটনা আপনার কাছ থেকে শুনলাম, সেটি অবিশ্বাস্য, অস্বাভাবিক বিষয়। এ নিয়ে মন্তব্যও করতে চাই না।’