কী শিক্ষা পাচ্ছে নতুন প্রজন্ম?

প্রথম আলো ফাইল ছবি

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যত নতুন যুগ আসছে, শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েই চলছে। শিক্ষা ছাড়া এই পুরো পৃথিবীই অচল। যেকোনো কাজ, তা যতটাই সামান্য মনে হোক, কোনো কাজ ঠিকমতো পারতে হলে সেই কাজ-সংক্রান্ত শিক্ষা থাকা আবশ্যক। কীভাবে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান সুব্যবস্থাপনা সঙ্গে পরিচালনা করতে হয় বা কীভাবে বড় বড় যানবাহন বানাতে হয়, এগুলো যেমন শিক্ষার বিষয়, তেমনি কীভাবে ভাত-তরকারির লোকমা বানিয়ে খেতে হয় বা কীভাবে গরম চায়ের পাত্রটি ধরলে হাত জ্বলে যাবে না, এরূপ বিষয়াদিও শিক্ষাবহির্ভূত কোনো আলোচ্য বস্তু নয়। পার্থক্য হলো, কিছু কিছু কাজে পারদর্শিতার পারিতোষিক হিসেবে পাওয়া যায় সনদ, বাকি অনেক কাজে দক্ষতার পুরস্কার সেই কাজের ওপর লব্ধ দক্ষতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

কতগুলো বিষয় আছে, যেগুলোর ব্যাপারে পরিশ্রম করে শিক্ষা অর্জন করতে হয়। আবার পরিস্থিতি শিখিয়ে দেয় এমন অনেক কিছু, যা কোনো শিক্ষক বা পুস্তকের মাধ্যমেও কেউ তার জ্ঞানের সমাবেশে সমাবিষ্ট করতে পারে না। পরিশ্রম হোক কিংবা পরিস্থিতি, ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, কোনো না কোনোভাবে একজন মানুষ যত দিন সজ্ঞান বেঁচে থাকে, সে তত দিন শিখতে থাকে। তবে যেকোনো ব্যক্তি তার সেই শিক্ষাগুলো সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে বুকে ধারণ করে চলে, যেই শিক্ষাগুলো সে তার জীবনের প্রথম দিকে, তথা শিশুকাল, কৈশোরকাল ও যৌবনকালে পেয়ে থাকে। উল্লিখিত এই সময়ে মানুষ যা শেখে, কর্মে তারই প্রতিফলন ঘটায় এবং পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও তা–ই প্রয়োগ করে থাকে।

তো চলুন, শব্দের মাধ্যমে নিম্নে অঙ্কিত কিছু দৃশ্য দেখে আসি এবং তা থেকে কিছু উপলব্ধির সামনে আসার চেষ্টা করি।

দৃশ্য ১

ভালো মানুষ হওয়ার চেয়ে ভালো নম্বর পাওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে নতুন প্রজন্মকে আগামীর জন্য তৈরি করার অভিমুখে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তবে আক্ষেপের বিষয় এই যে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য মা-বাবা, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ যতজন মিলে একজন তরুণকে যেমন চাপের মধ্যে ফেলেন; একজন ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য কতজনই-বা তাকে সেই তুলনায় কাছাকাছি পরিমাণও উৎসাহ দিয়ে থাকেন, তা এক অখণ্ডনীয় রহস্য।

দৃশ্য ২

বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেই ভালো শিক্ষার্থী, না হলে ‘মাথা আগাছায় ভর্তি’। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মগ্রন্থের বাণীর মতো সত্য করে সাজিয়ে এ গুজবের বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে শিক্ষার্থী হিসেবে একজনের যোগ্যতা নির্ভর করে সে কোন বিভাগ নিয়ে লেখাপড়া করছে, তার ওপর। অমৃতের মতো জেনেশুনে এ বিষ পান করে বৃহত্তর নতুন প্রজন্ম এটা অকপটভাবে স্বীকারও করে নিয়েছে যে কেউ বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেই মেধাবী, এ ব্যতীত ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক বা অন্য কিছু নিয়ে পড়লে ‘হাবিজাবি’।

দৃশ্য ৩

নেতিবাচককে আদর্শ মেনে চলার প্রবণতা। নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশের নিকটসমাজের বিভিন্ন নেতিবাচক বস্তু ও ব্যক্তি হয়ে ওঠে তাদের তীব্র আকর্ষণ ও আদর্শের পাত্র। হোক সেটা বিভিন্ন মাদকদ্রব্যাদি কিংবা ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত কোনো ‘আপাতদৃষ্টিতে সফল’ অপরাধী।

পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে আসার ফলে ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে অক্ষম

দৃশ্য ৪

সহিংসতা = সাহসিকতা। আলোচিত এ নতুন প্রজন্মের সিংহভাগ এ-ও মনে করে যে নিজের সাহসিকতা প্রমাণের এক কার্যকর অবলম্বন হচ্ছে সহিংসতায় লিপ্ত হওয়া এবং মানুষের মধ্যে নিজের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া। দেশের আনাচে-কানাচে ‘এলাকা’ নামের কোনো এক বোনের কেজিদরে অসংখ্য ‘বড় ভাই’-এর আবির্ভাব হওয়ার জন্যও এই সহিংসতার মাধ্যমে সাহসিকতা প্রদর্শনের প্রবণতা অনেকটাই দায়ী।
এমন আরও অনেক দৃশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে সম্ভাবনাময় এ নতুন প্রজন্মের আশপাশে দিয়ে। তাই ‘কী শিক্ষা পাচ্ছে নতুন প্রজন্ম?’ এখন ভাবনার একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘তারা কী সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে?’ ‘যেই শিক্ষা তারা পাচ্ছে, তার সম্পূর্ণটুকুই কী কল্যাণকর?’ ‘তারা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল কার্যপ্রণালির মধ্য দিয়ে বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হচ্ছে না তো?’ এরূপ পরিস্থিতিকে যত বেশি দিন প্রশ্রয় দেওয়া হবে, এমন প্রশ্নমালা ততই দীর্ঘ হতে থাকবে এবং আগামী দিনগুলো ততই অবনতিকর অবস্থায় পতিত হতে থাকবে।

কাজেই আর দেরি না করে এ প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার জন্য নতুন প্রজন্মকে ঘিরে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির দিকে গুরুত্বসহকারে নজর দিতে হবে এবং এর মাধ্যমে উদ্‌ঘাটিত সমস্যাগুলোকে দ্রুত সমাধান করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় নতুন যুগের পরিবর্তন সাধন করে নবীনদের জন্য একটি ইতিবাচক পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সৃষ্টি করা এখন সময়ের এক অন্যতম ন্যায্য দাবি।

*লেখক: নাফিস এহসাস চৌধুরী, শিক্ষার্থী, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি