২০১৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) উদ্যোগ নেয় কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার। গুচ্ছপদ্ধতির মাধ্যমে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও পাঁচ বছর পার হতে না হতেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন। সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয় পক্ষই চাইছে আগের মতো আলাদা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের বাছাই করা হোক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন পরিষদেরও মত, কৃষি গুচ্ছ থেকে বের হয়ে আসার। এরই মধ্যে ডিন পরিষদ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিন পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো আমরাও আলাদা ভর্তি পরীক্ষা চালু করব। গুচ্ছপদ্ধতির কারণে আমরা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিষয়ক পরিষদ দ্রুত এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে নন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই কৃষি গুচ্ছ থেকে বের হয়ে আসা উচিত। কারণ, এই পদ্ধতি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মানদণ্ড ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে বাধা সৃষ্টি করছে। আমরা আমাদের মান অনুযায়ী মেধাবী শিক্ষার্থী বাছাই করতে চাই, যা গুচ্ছপদ্ধতিতে সম্ভব হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. পারভেজ আনোয়ার বলেন, ‘শুরু থেকেই আমাদের ভর্তি পরীক্ষা স্বচ্ছ ও অনন্য ছিল। আমরা শুধু সরকারি মুক্তিযোদ্ধা ও উপজাতি কোটাই মেনে চলেছি, অন্য কোনো কোটা কখনো রাখা হয়নি। গুচ্ছভর্তি পরীক্ষায় আমাদের মান বজায় রাখা কঠিন, ফলে প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিলে মেধার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন সম্ভব হবে। গুচ্ছ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিষয় পছন্দের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিকল্প দিতে হয়, ফলে মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাকৃবির অনন্য মান ধরে রাখতে আগের পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) স্বকীয়তা রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক মো. গোলজার হোসেন। তিনি মনে করেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকা উচিত, কারণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘এক মেধাতালিকায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি আমি সমর্থন করি না। গুচ্ছপদ্ধতির ফলে দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি ভর্তি হচ্ছে। এতে সাংস্কৃতিক আদান–প্রদান কমে যাচ্ছে এবং ভালো শিক্ষার্থীরা মান হারাচ্ছে। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তুলনামূলক ভালো বিষয়ের পরিবর্তে নিজ এলাকার কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, যা তাদের মেধার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছে না।’
উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. বকুল আলী বলেন, ‘পূর্বের একক ভর্তি পরীক্ষায় কখনো কোনো ভুল বা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্যান্য কেন্দ্রের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বারবার। একসময় শীর্ষস্থানীয় মেধাবীরা বাকৃবিতে ভর্তি হতে পারত, কিন্তু গুচ্ছপদ্ধতিতে কম জিপিএধারীরাও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, যা বাকৃবির স্বকীয়তা নষ্ট করছে।’
কৃষি অনুষদ, পশুপালন অনুষদ ও কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের বিভিন্ন বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে জানা যায়, গুচ্ছের মাধ্যমে ভোগান্তি কমার বদলে বেড়েছে। নিজের বাছাই করা স্থানে পরীক্ষার কেন্দ্র পড়ে না বেশির ভাগেরই। যাতায়াতের সমস্যা থেকেই যায়। আবার একসঙ্গে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা হয়ে যায়। অর্থাৎ একটি মাত্রই সুযোগ থাকে পরীক্ষা দেওয়ার। আলাদা আলাদা পরীক্ষা হলে শিক্ষার্থীরা যার যার লক্ষ্য নির্ধারণ করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবেন। বাকৃবিতে পড়তে ইচ্ছুক যারা, তারা শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেত।
ভেটেরিনারি অনুষদের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট তৈরির অন্যতম কারণ হলো এই গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। গুচ্ছের আগে প্রতিবছর যথাসময়ে পরীক্ষা হতো এবং ক্লাস শুরু হয়ে যেত। প্রতিটি বর্ষের ক্লাস-পরীক্ষাতেও ধারাবাহিকতা ছিল। এখন কৃষি গুচ্ছ পরীক্ষা হয় সবার শেষে এবং ভর্তি সম্পন্ন করে ক্লাস শুরু করতেও দেরি হয়ে যায়। বিভিন্ন অনুষদেই পরীক্ষাগুলো অনিয়মিত এবং দেখা যায় যে সেমিস্টারের নির্ধারিত সময়ে ক্লাস শেষ করে পরীক্ষা সম্পন্ন করাটাও অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।'
শিক্ষার্থীদের দাবি, আলাদা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা ও মেধার মূল্যায়ন পুনরুদ্ধার করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া জানান, গুচ্ছ থেকে বের হয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।